রবিবার, জুন ১৫

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান: নিয়ন্ত্রণহীন উন্মুক্ত জায়গা ও মাদকের আখড়া: প্রশাসনের দায়

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় নাম। এখানেই পাকিস্তান আমলে বাঙালির রাজনৈতিক চেতনা জেগে উঠেছিল, এখানেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়া হয়েছিল, যা স্বাধীনতার ডাক হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু আজ এই ইতিহাস-সমৃদ্ধ উদ্যান কী অবস্থায় আছে? বাস্তবতা হলো—এখন এটি অনেকাংশেই পরিণত হয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণহীন উন্মুক্ত এলাকায়, যেখানে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শুরু হয় অবৈধ কর্মকাণ্ড, মাদক সেবনের আসর, যৌন বাণিজ্য এবং নানা অপরাধের মিছিল।

এই পরিণতি শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থানের অবমূল্যায়ন নয়, বরং রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান শুধু একটি পার্ক নয়; এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের জীবন্ত স্মারক। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক ও জাতীয় জাদুঘরের পাশেই অবস্থিত, রাজধানীর অন্যতম কৌশলগত ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। এখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভ্রমণে আসেন—ছাত্র-ছাত্রী, jogger, প্রবীণ নাগরিক ও পরিবারের সদস্যরা।

তবু, প্রতিদিনের জীবনচিত্রে দেখা যায়, বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলেই উদ্যানটির পরিবেশ বদলে যায়। সুশৃঙ্খল পারিবারিক বিনোদনের পরিবর্তে ছায়া নেমে আসে অবাধ মাদক সেবন, অসামাজিক কর্মকাণ্ড এবং কখনো কখনো চুরি-ছিনতাইয়ের রূপে। গতকাল তো হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত দেখতে হয়েছে আমাদের।

বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন মাদকসেবীদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা এমনকি ইনজেকশন-ভিত্তিক নেশাদ্রব্য এখানে সহজলভ্য। উদ্যানের নির্জন কোণ, ঝোপঝাড় বা খোলা ঘাসের জমি—সবই এখন ‘স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত।

স্থানীয়দের মতে, কিছু স্থানীয় চা দোকান বা হকারদের মাধ্যমেও চলে এসব দ্রব্যের আদান-প্রদান। মাঝে মাঝে পুলিশ টহল বা অভিযান চালালেও তা এককালীন। কোনোরূপ স্থায়ী ব্যবস্থা বা মনিটরিং নেই।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ‘উন্মুক্ত’—এই ধারণাটিই আজ এর দুর্দশার মূলে। জনগণের জন্য খোলা রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো নিরাপত্তা কাঠামো বা নিয়মিত প্রশাসনিক তদারকি নেই। কোনো নিয়ম নেই প্রবেশ-প্রস্থান সময়ের, নেই পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, নেই আলোচনার মতো পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা।

এই অগোছালো অবস্থা শুধুমাত্র মাদকসেবী নয়, অন্যান্য অপরাধীদেরও উৎসাহিত করে। নারী ও শিশুদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থান।

সন্ধ্যার পর অনেক নারী jogger বা পথচারী হয়রানির শিকার হন। কিছু জায়গায় অনভিপ্রেত দৃষ্টিভঙ্গি, অশালীন কথাবার্তা বা এমনকি শারীরিক হেনস্থার ঘটনাও ঘটে থাকে। বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট এসেছে, যেখানে উদ্যানের কিছু অংশে ‘যৌন বাণিজ্য’ বা দেহ ব্যবসার আখড়া তৈরি হয়েছে।

এখানে প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্রযন্ত্র কী করছে?

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাদকসেবী কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেখা গেলেও, তারা মূল চালিকা শক্তি নয়। এদের পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত মাদক সিন্ডিকেট, যা শুধু স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা নয়—পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও অদৃশ্য প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পার্কের আশপাশের এলাকায় কিছু ‘চিহ্নিত’ ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মাদক বেচাকেনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছে। এই চক্র প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ‘মাসিক বখরা’ দিয়ে থাকে, যার ফলে বেশিরভাগ সময় তারা আইনের আওতার বাইরে থেকে যায়।

এমনকি মাঝেমধ্যে ‘নাটকীয়’ কিছু ধরপাকড় বা অভিযান চালানো হলেও তা হয় সাধারণ মাদকসেবীদের উপর, আর প্রকৃত ব্যবসায়ী ও মাস্টারমাইন্ডরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এই পরিস্থিতিতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে—আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করে মাদকবাণিজ্য? প্রশাসন, না সেই প্রশাসনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা গোপন বাহিনী?

একটি ঐতিহাসিক স্থানের এমন অব্যবস্থাপনা স্পষ্টতই রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দায় এড়ানো যায় না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ডিএমপি ও পর্যটন কর্তৃপক্ষ—তিনটি পৃথক সংস্থা এই উদ্যানের সঙ্গে জড়িত হলেও সমন্বিত কোনো রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা দেখা যায় না।

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো—এই অপরাধগুলো ঘটে যাচ্ছে বছরের পর বছর, অথচ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোন নজির নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও, তা কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।

যারা গ্রেফতার হয়, তারা কয়েক দিনের মধ্যেই জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা অর্থবলের কারণে মামলা হয় না বা প্রমাণ হয় না। তদন্তে ধীরগতি, সাক্ষীর অনুপস্থিতি এবং প্রশাসনিক ‘গাফিলতি’র কারণে একের পর এক মামলা ধামাচাপা পড়ে।

ফলাফল—বিচারহীনতার সংস্কৃতি, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সাধারণ মানুষকে করে হতাশ ও অসহায়।

এই পরিস্থিতির সমাধান হতে হলে, শুধু গাছপালা পরিষ্কার বা পুলিশি অভিযান দিয়ে হবে না।
প্রথমেই দরকার—এই মাদক সিন্ডিকেটকে ভাঙা।
তার জন্য প্রয়োজন:

  1. স্বাধীন ও দুর্নীতিমুক্ত তদন্ত টিম গঠন করা, যা প্রশাসনের বাইরের শক্তির মাধ্যমে তদারকি হবে।
  2. মাসিক রিপোর্টিং ও অডিট চালু করা—উদ্যানভিত্তিক অপরাধসংক্রান্ত তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
  3. উচ্চ পর্যায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রশাসনের কেউ যদি মাদক চক্রে জড়িত থাকে, তারও বিচার হয়।
  4. সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা, যারা অবসরের আগে সুবিধা নিয়েছে, অথবা গোপনে এই চক্রে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব রেখেছে।

যদিও চিত্রটি অনেকটা হতাশাজনক, তবুও এখনো সময় আছে পুনরুদ্ধারের। উদ্যানটি সংস্কার, পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে একটি নিরাপদ, পারিবারিক এবং ইতিহাসসচেতন স্থানে রূপান্তর সম্ভব। এর জন্য কিছু পদক্ষেপ প্রস্তাব করা যেতে পারে:

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই মাদকসেবীরা অনেকেই যুবক, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাদের অনেকেই হয়তো কর্মসংস্থানের অভাবে, পারিবারিক ভাঙনের কারণে বা বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় এই পথে এসেছে।

তাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র, কাউন্সেলিং ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। এই সমস্যাকে শুধুমাত্র “অপরাধ” হিসেবে না দেখে, “মানবিক সংকট” হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

সবশেষে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দুর্দশা একটি জাতীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আমরা আমাদের ইতিহাস, আমাদের গৌরব এবং আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রতারণা করছি এই উদ্যানকে অবহেলা করে।

প্রশাসনের উচিত এই উদ্যানকে কেবল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং একটি স্মৃতি ও সম্মানের পবিত্র স্থান হিসেবে রক্ষা করা। এবং সেই দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের নয়, আমাদের সকলের—জনগণেরও।

এখন সময় হয়েছে—সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে পুনরুদ্ধার করার। সময় হয়েছে প্রশ্ন তোলার, এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ—সমাধানের পথে এগোনোর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *