শনিবার, ডিসেম্বর ১৪

ডক্টর মুজিবুর রহমান : যুগসেরা তাফসির অনুবাদক ও সুসাহিত্যিক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, আরবিবিদ, বিদগ্ধগবেষক, তাফসীর ইবনে কাসীর অনুবাদক, ইসলামী সাহিত্য রচনাকারী ডক্টর মুজিবুর রহমান সেরা আল-কুরআন গবেষক। মাতৃভাষা বাংলা, আরবি, উর্দু, ফার্সি ও ইংরেজি এ পাঁচটি ভাষায় তার সমান দখল ছিল। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কারণে সকল ভাষার সাহিত্যক্ষেত্রেই তার বিচরণ ছিল অবাধ।

বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা, ইজাজুল কোরআন কণিকা, আল কোরআনের গল্প ইত্যাদি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করে কুরআন গবেষণার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে কুরআন জগতে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।

আরবি ছোট গল্পকার মোস্তফা লুতফী আলমান ফালুতীর ‘আল-আবারাত’ছোট গল্প সংকলনটি ‘মিশরের ছোট গল্প’ নামে অনুবাদ করে আরবি সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।

তাফসীরে ইবনে কাসীর সেরা তাফসির বিল মাসুর তাফসীরটি সহজ সরল বঙ্গানুবাদের মাধ্যমে তিনি তাফসীর জগতে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হন।

উর্দু সাহিত্যে তার উচ্চাঙ্গ প্রবন্ধগুলির সংকলন “মাযামীনে মুজীব” প্রকাশিত হলে তিনি উর্দু সাহিত্য জগতে বিরাট অবস্থান করে নেন।

যার কথা বলছিলাম তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের স্বনামধন্য পন্ডিত ব্যক্তিত্ব।

জীবন বৃত্তান্ত
ডঃ মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ১৯৩৬ সালে বাবলাবোনা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল গণি রাজশাহীর দাদনচক কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।

শিক্ষাজীবন
তিনি মাদ্রাসা-ই- আলীয়া ঢাকা হতে ১৯৫৪ সালে ১ম শ্রেণীতে কামিল হাদীছ, লাহোর হতে দরসে নিজামিয়ায় তাকমীল এবং ওরেয়েন্টাল কলেজের অধীনে এফ, এম এরপর মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম. ও. এল. ১৯৬২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান-সহ আরবী বিভাগ হতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন
১৯৮১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে “বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা” শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।

অধ্যাপনা শুরু
১৯৬২ সালে দাদনচক ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে নওয়াবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে গিয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে পরবর্তীকালে সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষে তিনি প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

তিনি কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তিনি লণ্ডনস্থ ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের পরিচালক পদেও কর্মরত ছিলেন।

অবদানসমূহ
উর্দূ ভাষায়
বাংলাদেশ ছাড়া দিল্লী হায়দরাবাদ, লাহোর, করাচী এবং ইসলামাবাদের বিভিন্ন প্রথম শ্রেণীর উর্দূ পত্রিকায় তাঁর যে সব চিন্তাবিদ ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধমালা ছাপা হয়, সেগুলি পরবর্তীতে নয়াদিল্লী বেনারস ও ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ইংরেজি ভাষায়
পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে ইংরেজী ভাষায় ‘ইসলামিক ষ্টাডিজ’ নামক এক উচ্চাংগের পত্রিকায় তাঁর ইংরেজী প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতব্য। এটি প্রখ্যাত তাফসীরকার কাজী বায়যাবীর জীবনী ও সাহিত্যকীর্তি সংক্রান্ত। তিনি ইতোপূর্বে আমেরিকার ‘টেস্টিমনি’ ইংরেজী প্রত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।

বিভিন্ন ভাষায় লিখিত তাঁর পরিচিত গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো-
আল কুরআন বিষয়ক গবেষণা
১. কোরআন চর্চায় তার অবদান
আল কুরআনী তার সবচাইতে বড় অবদান হলো বিশ্বসেরা তাফসীর তাফসীরে ইবনে কাসীর ৮ খন্ডে বঙ্গানুবাদ। এ তাফসীর কি তাকে বাংলা ভাষাভাষী কোরআন প্রেমীদের মাঝে স্থান করে দিয়েছে। এ গ্রন্থটি ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
২. কুরআন কনিকা
৩. বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা। এটি তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। ১৬ বৎসরে নিরলস সাধনা করে কুরআন অনুবাদের ইতিহাসে এক অমর কাজ করে গেছেন। এ গবেষণাটি সম্পন্ন করেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ডঃ এম এ বারীর তত্ত্বাবধানে।
৪. কুরআনের চিরন্তন মুজিজা’ এ গ্রন্থটি তাকে চির অমর করে রেখেছে। এটিও ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়।

আরবী সাহিত্যে তার অবদান
১. মিসরের ছোট গল্প (আরবি ছোট গল্প সংকলন আল আবারাতের বঙ্গানুবাদ)
২. আরবী সাহিত্যের ইতিহাস

জীবনী গ্রন্থ
১. “মাযামীনে মুজীব” (নয়া দিল্লী) ‘
২. ইমাম বুখারী’,
৩. ইমাম মুসলিম’,
৪. মুহাদ্দিস প্রসঙ্গ’
৫. ইব্রাহীম আ.
৬. মদীনার আনসার ও হযরত আবু আইয়ুব আনসারী
৭. মওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী (র.)
৮. ইদ্রীস মিয়া
৯. বিশ্বসেরা মুতাজিলা তাফসির আল কাশরাফের তাফসীর কারক আল্লামা জারুল্লাহ আজজামাখ শারীর জীবনী।

সাহিত্য বিষয়ক
১. মুসলমানদের সাহিত্য সাধনা
২. ‘ইসলামী সাহিত্যে তসলিমুদ্দীন’
৩. নবীজীর (স.) নামাজ

তার রচনাবলীর অধিকাংশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে
মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি’ ‘ইতিহাস পরিষদ’ ‘এসিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘বাংলা একাডেমীর’ জীবন সদস্য। কলকাতার ইন্দো-আরব কালচারাল এ্যাসেসিয়েশনও তাঁকে সদস্যপদ প্রদান করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গমন
তিনি বিদেশের বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান এবং চিন্তাদীপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধরাজির উপস্থাপনা করে দেশের প্রতিনিধিত্ব ও মর্যাদা বর্ধন করেন।

তিনি মক্কা ও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী ও জওহারলাল নেহরেু বিশ্ববিদ্যালয়, পাটনা ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, করাচী, মুলতান ও বাহাওয়ালপুর বিশ্ববিদ্যালয়, লাহোর ও ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটি লন্ডন, বার্মিংহাম, লেইসটার, তুরস্কের ইসতামবুল, রাজস্থান, আসামের রতনপুর, হাইলাকান্দী প্রভৃতি শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারেও তিনি যোগদান ও মূল্যবান প্রবন্ধ পাঠ করেন।

প্রায় তিন যুগ ধরে নিরলস শিক্ষাদান ও লাগাতার সাহিত্য সেবাই তাঁর জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য।

নিরন্তর সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর বিচিত্র অন্তদৃষ্টি ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সমাহার ঘটেছে বিভিন্ন গ্রন্থে। বর্তমানে তিনি সুদূর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে এক ইসলামী সেন্টারের ডাইরেক্টর ছিলেন।

পরলোকগমন
তিনি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার বিকেলে আল্লাহর সান্বিধ্যে চলে যান।
انا لله وانا اليه راجعون
কুরআনের এই মহাসাধকে আল্লাহতালা জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমীন।

লেখক: প্রফেসর, আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং সাবেক ডিন, থিওলজী এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *