রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৫

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনসমূহে ধর্মীয়বিধি প্রতিপালনে অসহনশীলতা বিতর্ক এড়িয়ে চলা সময়ের দাবি

গত ১৩-১২-২০২৩ তারিখ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ১জন পরীক্ষার্থীনীর মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়।

বিভাগ মেয়েটির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আগামী ২৭-১-২০২৪ তারিখ মৌখিক পরীক্ষার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বিভাগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।

তবে আমার মাঝে এ বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

১. এমন কি ঘটেছিল যে একটি মেয়ের মৌখিক পরীক্ষা যথাসময়ে আমরা নিতে পারিনি।

২. বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র প্রফেসর মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে উপস্থিত থাকার পরেও বিষয়টি কেন সমাধান করা যায়নি।

৩. কমিটিতে একজন মহিলা শিক্ষক থাকার পরেও নেকাব বিষয়ে কেন এ ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভূত হলো।

৪. ডিন অনুষদের একাডেমিক প্রধান।
গত এক মাস দশ দিনে বিষয়টি সমাধানে তিনিও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন।

৫. ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় বিষয়টি সমাধানে সদয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বিষয়টি এতদূর গড়াতো না।

৬. মেয়েটি পরীক্ষা বিষয়ক কোন অপরাধ করে থাকলে তাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বহিষ্কারও করতে পারিনি।

বিষয়টি আমার আওতাভুক্ত কিনা জানি না। এর পরেও আমি গত ২১ তারিখ নিজের উদ্যোগে সে বিভাগে গিয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যানসহ শিক্ষকদের বক্তব্য শুনে ভাইভা গ্রহনের ব্যাপারে বিনীত অনুরোধ জানাই এবং আমি ছাত্রীর সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করি।

অদ্য চেয়ারম্যান থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে বিভাগে ডেকে উক্ত ছাত্রীর সাথে কথা বলি। উভয় পক্ষের কথার মধ্যে কোন গরমিল আমি পাইনি। তবে উভয় পক্ষের ইগো জিদ এর বহি:প্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

সেও মুখ খুলতে নারাজ ছিল আর বিভাগও নেকাব খোলা ছাড়া পরীক্ষা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করায় পরিস্থিতি আজ এ পর্যন্ত এসেছে।

আমি কাউকে কোন দোষারোপ করছি না। এখানে ধর্মীয় প্রসঙ্গটিও আনছি না। আমি আমাদের ব্যর্থতার কথা বলছি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা হলো বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল আর শিক্ষকরা হলেন সে বাগানের পরিচর্যাকারী।

আমরা দাবি করি শিক্ষক হলেন পিতা। তাহলে এতগুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি মেয়ের নেকাব না খোলার আবদার আমরা রক্ষা করে তার পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। তাহলে আমরা কেমন পিতা?

আবার মেয়েকেও বলেছি তুমি কেমন মেয়ে যে পিতাদের কাছে মানার মতো ১টি আবদার করতে পারোনি। পরীক্ষার মত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তুমি বিভাগকে সহযোগিতা করতে পারোনি।

আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে সাত সতেরো ঘাট পার হয়ে বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত হতে হয়। যেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোন স্কোপ নেই। এ ঘাটগুলো হলো –

১. শিক্ষার্থীর আবেদনে উল্লেখিত নম্বরপত্রী বোর্ডের নম্বর পত্রের সাথে অনলাইনে মিলিয়ে সে আবেদনের যোগ্য কি-না, তা নিশ্চিত করা হয়। বর্তমান বিজ্ঞান বিষয়টি আরো সহজ করে দিয়েছে।

২. আবেদনের যোগ্য হলেই কেবল কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা তাদের প্রবেশপত্র সরবরাহ করে থাকি।

৩. ভর্তি পরীক্ষার দিন কম্পিউটারে পরিক্ষীত সরবরাহকৃত দুটি প্রবেশপত্রের সাথে পরীক্ষার্থীর চেহারা মিলিয়ে সিগনেচার করে একটি তার কাছে রাখা হয় আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় জমা রাখে।

৪. গুচ্ছ পরীক্ষায় কেউ চান্স পেলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে কিনা এ বিষয়ে মোবাইলের মাধ্যমে নিশ্চায়ন করতে হয়।

৫. গুচ্ছের বাইরের পরীক্ষার্থীদেরকে ডিন অফিসে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সকল কাগজপত্র দেখিয়ে বিভাগ নির্বাচন করতে হয়।

৬. এডমিট সহ তার সকল মূল কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হয়।

৭. পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি দিয়ে থাকে।

৮. শুধু রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্তদের নাম বিভাগে প্রেরণ করা হয়।

৯. পরীক্ষার পূর্বে প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে বিভাগীয় সভাপতি ও ডিনের মাধ্যমে ফরম ফিলাপ করতে হয়।

১০. পরীক্ষার্থী নির্ধারিত প্রতিটি কোর্সে ক্লাস করেছে কিনা কোর্সশিক্ষক তা সত্যায়ন করেন।

১১. শিক্ষকের নির্ধারিত ক্লাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েই কেবল বিভাগীয় সভাপতি ফরম ফিলাপের অনুমতি দিয়ে থাকেন।

১২. ডিন নিশ্চিত হয়েই প্রতিটি ফরমে সিগনেচার করেন।

১৩. এ পরীক্ষার্থী হলের নিবন্ধনভুক্ত কিনা সেটা নিশ্চয়ন করেই হলের প্রভোস্ট ফরমে সিগনেচার করেন।

১৪. সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একটি করে এডমিট দিয়ে থাকেন।

১৫. প্রতিটি সেমিস্টারে কমপক্ষে পাঁচটি করে কোর্সে এক একজন পরীক্ষার্থীকে অংশগ্রহণ করতে হয়।

১৬. পরীক্ষার হলে চার থেকে ছয়জন পরিদর্শক পরীক্ষার্থীর এডমিট দেখে তার উত্তরপত্রে সিগনেচার করে থাকেন।

১৭. সর্বশেষ ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হয়ে প্রবেশপত্র দেখিয়ে হাজিরা সীটে প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে সিগনেচার করতে হয়।

১৮. নিয়মতান্ত্রিক পরীক্ষার পূর্বেই প্রতি কোর্সের ৩০ নাম্বারের জন্য চার পাঁচটি করে প্রেজেন্টেশন/ টিউটোরিয়াল/ ইনকোর্স/ কুইজ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে হয়।

আমার প্রশ্ন হল এই শিক্ষার্থী যদি আমার বিভাগের না হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিভাগের শিক্ষক এই ১৮টি স্তরে কাকে পড়ালাম? কার পরীক্ষা নিলাম? কাকে ১৮টি স্তর পাড় করিয়ে সেমিস্টার ও ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করালাম?

আর আজকে ভাইভাতে বিভাগের শিক্ষার্থী কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের কারণে তাকে অনর্থক হয়রানি করার প্রয়াস কতটুকু বিজ্ঞোচিত হয়েছে বিষয়টি সকল বিজ্ঞজনকে ভাবিয়ে তুলেছে।

বোরকাই যদি শিক্ষার্থীনীর চেনার প্রতিবন্ধক হয়, তাহলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক বোরকা নেকাববিহীন ছাত্রীকে চতুর্থ বর্ষে ভুয়া প্রমাণে বহিষ্কার করা হয়। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির ৪-৫ বছর পরেও অনেক ছেলে শিক্ষার্থীকে ভুয়া প্রমাণে কেন বহিষ্কার করা হয়? সেখানে তো তাদের বোরকা বা নেকাবের প্রতিবন্ধকতা ছিল না!

এ ধরনের ঘটনা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো ঘটেছে, যার ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক। এবং ইতিপূর্বে আমি নিজ উদ্যোগেও একটি বিভাগের এ ধরনের সমস্যার সমাধান করেছি।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সদয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে বারবার এমন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা এবং তাদের বিষয়ে শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণেই সেটি বেড়েই চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কেন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোন স্থানে এ ধরনের ঘটনা না ঘটুক এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইউজিসিসহ কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

পরীক্ষা গ্রহণে কোনো ক্ষতি বা লাভ হবে না এমন বিষয়ে শুধু নেকাব বোরকা নয়, ধর্মীয় যে কোন বিষয় নিয়ে অনর্থক বিতর্ক সৃষ্টি করে শান্ত পরিস্থিতিকে অশান্ত করার প্রয়াস আমরা না চালাই। সেটাই হবে দেশজাতির জন্য মঙ্গল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *