|| মো. ওমর ফারুক ||
চন্দ্রবর্ষের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মিরাজের অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে হিসেবে এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সারাদেশে লাইলাতুল মিরাজ পালিত হবে। এ রাতে ওয়াজ, নসিহত, আলোচনার আয়োজন-সহ মুমিন বান্দারা ইবাদতে মশগুল থাকবেন।
হযরত মুহাম্মদ সা. অন্যান্য নবী-রাসূলদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ স্বরূপ মহান আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য নবী-রাসূলদের তুলনায় তাঁকে সর্বাধিক মু’জিযা উপহার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। যা অন্যান্য নবী রাসূলদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। মহানবী সা.-এর জীবনের মু’জিযাসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মু’জিযা হিসেবে খ্যাত “লাইলাতুল মিরাজ”। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তন্মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ লাইলাতুল মিরাজের স্থান সর্ব শীর্ষে। কেননা এর প্রেক্ষাপট, ঘটনা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কালামে হাকিমে ঘোষণা করেছেন- ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় (মাহবুব) বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাতে আপন মহান নির্দশনসমূহ দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ১)
আয়াতে কারিমায় ‘আসরা’ দ্বারা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মিরাজ রাতে হয়েছে। ‘আসরা’ শব্দটি ‘ইসরা’ ধাতু থেকে উৎপন্ন। এর অভিধানিক অর্থ রাতে নিয়ে যাওয়া। আর ‘বি-আবদিহী’ দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। আমার বান্দা বলে প্রেয়ময়তা বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কোনো বান্দাকে আমার বান্দা বলার দ্বারা তাঁর প্রতি ভালোবাসাই বুঝায়।
এ আয়াতে কারিমার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মিরাজ এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যাতে লক্ষণীয় বিষয় হলো- আয়াতের প্রারম্ভেই ‘সুবহানা’ শব্দ ব্যবহার করে মহান আল্লাহ তা‘আলা জগৎবাসীদের জানিয়ে দিলেন যে, মিরাজ তোমাদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় মনে হবে অর্থ্যাৎ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বের মাধ্যমেও মিরাজ-এর ঘটনার বাস্তবতা উপলব্দি করা সম্ভব নয়। কেননা “সুবহানা” শব্দটি আশ্চর্যজনক বিস্ময়কর বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় অথচ এটাই বাস্তব ঘটনা।
নবুওতের একাদশ কিংবা দ্বাদশ বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখ (২৬ দিবাগত) সোমবার রাতে মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়। মহানবী সা. যখন জাগতিক ও পারিপার্শ্বিক অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হন, পিতৃব্য আবু তালিব ও বিবি খাদিজা রা.-এর আকস্মিক ইন্তেকাল হয়, অন্যদিকে কাফেরদের অত্যাচার তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে; তখন মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় হাবিবকে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে এনে সান্তনা দিয়ে আদর্শ সমাজ সংস্কারের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
মিরাজ শব্দটি উরূজ শব্দমূলের রুপান্তর, যার অর্থ উর্দ্ধগমন। পবিত্র মক্কা মুকাররমা থেকে রাতের একটা ক্ষুদ্র অংশে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তাশরীফ নেয়াকে বলা হয় ইসরা, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমানসমূহ ভ্রমণ ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাকে বলা হয় মিরাজ ।
লাইলাতুল মিরাজকে তিনটি স্তরে বা পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে ।
এক. বায়তুল্লাহর হাতিম হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় ‘আসরা’।
দুই. বায়তুল মুকাদ্দাস হতে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় ‘মিরাজ’।
তিন. সর্বশেষ তথা তৃতীয় স্তরটা হলো সিদরাতুল মুনতাহা হতে আরশ ও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত ভ্রমণ করাকে ‘ইরাজ’ বলা হয়।
কাবার হাতিম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সংগঠিত ‘ইসরা’:
মহানবী রজবের ২৭ তারিখ রাতের শেষার্ধে তাঁর দুধ বোন উম্মে হানী বিনতে আবি তালিব এর গৃহে (বর্তমানে কাবা সংলগ্ন হাতিম) বিশ্রাম করছিলেন। এমন সময় আল্লাহর হুকুমে হযরত জিবরাইল আ. একদল ফিরিশতা ও বোরাক নিয়ে মহানবী সা.-এর নিকট আসলেন। তাঁকে জাগিয়ে তুললেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ (সীনাচাক) করে জমজম কুপের পানি দ্বারা তা ধৌত করলেন এবং রহমত, বরকত ও নূরে এলাহী দ্বারা বক্ষ মোবারক পরিপূর্ণ ও মহিমান্বিত করলেন। হাউজে কাওসারের পানি দ্বারা গোসল দিলেন, জান্নাতি পোশাকে প্রিয় নবীজীকে সুসজ্জিত করে কাবা শরিফের হাতিমে নিয়ে আসেন। এরপর আল্লাহ পাকের আমন্ত্রণের কথা জানালে প্রিয় মিলনের স্বতঃস্ফুর্ত চিত্তে তিনি বোরাকে আরোহন করেন।
উল্লেখ্য যে, বোরাক একটি বৈদ্যুতিক যান। বোরাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের গতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। বোরাকের গতি ছিল তার চেয়েও বেশী।
অতঃপর সেটি ত্বরিতগতিতে মদিনা মুনাওয়ারা, সিনাই পর্বত, হযরত ঈসা আ.-এর জন্মস্থান ‘বায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে ফিলিস্তিন জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছাল। নবীকুল শিরোমণি সেখানে আম্বিয়ায়ে কিরামের সঙ্গে জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তিনি হলেন ‘ইমামুল মুরসালিন’ অর্থাৎ সব নবী-রাসূলের ইমাম। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ এখানেই সমাপ্ত হয়। পবিত্র কুরআনের ভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইসরা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বায়তুল মুকাদ্দাস হতে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সংগঠিত ‘মিরাজ’:
নামাজ সমাপনান্তে উর্দ্ধ জগতের ভ্রমণ প্রস্তুতি শুরু হলো। তারপর নবী করিম সা. বোরাকে আরোহণ করলে তা দ্রুতগতিতে মিরাজ বা ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ শুরু করে। এ সময় বিশ্বস্রষ্টার নভোমণ্ডলের অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখে তিনি বিমোহিত হন। প্রথম আকাশে হযরত আদম আ., দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা আ. ও হযরত ইয়াহ্ইয়া আ., তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ আ., চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিস আ., পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন আ., ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা আ. এবং সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহিম আ.-এর সঙ্গে নবী করিম সা.-এর সাক্ষাৎ হলে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌছেন।
সপ্তম আসমানে অবস্থিত ‘বায়তুল মামুরে’ অসংখ্য ফেরেশতাকে তাওয়াফরত অবস্থায় আর অনেককে সালাত আদায় করতেও দেখেন নবীজ সা.। এরপর তিনি জিবরাইল আ.-এর সঙ্গে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন করেন। মিরাজকালে মহানবী সা. সৃষ্টিজগতের সবকিছুর রহস্য অবলোকন করেন এবং আল্লাহর অসীম কুদরতের যাবতীয় নিদর্শন দেখেন। তিনি আল্লাহর বিধিবিধান, ভাগ্যলিপি অবিরাম লিখে চলেছে যে কলম, সেটাকেও লিখনরত অবস্থায় দেখতে পান। এ ছাড়া আলমে বারজাখের অসংখ্য দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করে পুনরায় সিদরাতুল মুনতাহায় ফিরে আসেন।
সিদরাতুল মুনতাহা হতে আলমে আমর বা আদেশ জগতে সংগঠিত ‘ইরাজ’ :
সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে তিনি জিবরাইল আ.-কে স্বরূপে দেখতে পান। এখানে তাঁর বাহনও পরিবর্তন হয়। একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের কুদরতি বাহন ‘রফরফ’ এসে হাজির হয়। রফরফ অর্থ চলন্ত সিঁড়ি (Escalator), যা ছিল গদি বিশিষ্ট আসনওয়ালা। যার গতি ছিল আলোর গতি অপেক্ষা লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী। নবী করিম সা. ‘রফরফে’ আরোহণ করে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার সন্নিকটে পৌঁছালেন এবং আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন।
তিনি স্থান-কালের ঊর্ধ্বে লা মাকাম-লা জামান স্তরে পৌঁছান। নূর আর নূরের আলোড়ন দেখে তিনি অভিভূত হয়ে যান। কুরআন পাকে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন- তিনি সিদরাতুল মুনতাহা নামক অপূর্ব সৌন্দর্যময় একটি বৃক্ষ দেখেছিলেন। যার অনতিদূরেই জান্নাতুল মাওয়া নামক বেহেশত অবস্থিত। আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনাবলীর কিয়দংশ তিনি পরিদর্শন করেছিলেন। এই সকল নিদর্শন দেখায় তাঁর চক্ষু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি কিংবা তিনি লক্ষ্যকে অতিক্রম করেননি (সূরা : নজম, আয়াত-১৮৭)।
সেখানে আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর দিদার হয় এবং কথোপকথন হয়। এ অবস্থাকে মুতাশাহেবাত বা রহস্যজনক অবস্থা বলা হয়। কুরআনুল করিমে এই মাকামকে “কাবা কাউছাইনে আও আদনা” বলা হয়েছে এই কারণে যে, এর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের সময় তার বাশারিয়াত উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহদানিয়াতের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি এই মাকামকে তাসাউফের ভাষায় “ফানা” বলা হয়। তাফসীরে রুহুল বায়ানে বলা হয়েছে- রাসূল সা. সৃষ্টির পূর্ব হতে নূরের তৈরি ছিলেন, তার এই নূরের তাজাল্লির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্য লাভ করেন।
আল্লাহ পাকের সরাসরি দর্শন লাভ এবং আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল সা. সিনায় ফয়েজ পৌঁছানোর মাধ্যমে আসমান জমিনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান; রাসূল সা. মাকামে কাবা কাউছাইনে উপনীত হওয়ার পর আল্লাহ পাক সত্তর হাজার নূরের পর্দা তুলে দিয়ে আল্লাহ পাকের কুদরতি সত্তার দর্শনদানে রাসূল সা.-কে ধন্য করেন।
হুজুর সা. আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে আত্তাহিয়্যাতো লিল্লাহে পড়ে আল্লাহর শুররিয়া আদায় করেন। মহান আল্লাহ খুশী হয়ে তাঁর হাবীবকে সালাম দেন। সালাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ফেরেশতারা কালেমা শাহাদৎ পড়ে সাক্ষী দেয় যে, আল্লাহ এক ও মুহাম্মদ সা. তাঁর রাসূল তারপর আল্লাহ স্বয়ং ও ফেরেশতারা মহান নবীর উপর দরূদ পাঠ করেন।
অতপর আল্লাহ তা‘আলার দর্শনের পরে রাসূল পাকের সাথে আল্লাহর যে মহব্বত ভালোবাসা বিনিময় হয়, তার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা রাসূল পাকের স্কন্ধ ও বক্ষ দেশের উপর আল্লাহর কুদরতি হতে বুলিয়ে দেন, যেমন- হাদীসে এসেছে, আল্লাহ পাক তার কুদরতি হস্ত তালু আমার দুই স্কন্ধের মাঝে স্থাপন করেন। অতপর আমি আল্লাহ পাকের হস্ত তালুর শীতলতা আমার বক্ষদেশে উপলব্ধি করি। অতপর আমি ভাসমান ও জমিনে বিদ্যমান যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। আল্লাহর সাথে সালাম-কালাম, আলাপ-আলোচনার পর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন এবং বলেন- এই ৫ ওয়াক্ত আপনার উম্মতের জন্য মিরাজ। তারা নামাজের মধ্যে আমার সঙ্গে কথা বলবে। হাদীসে এসেছে- নামাজ মু’মিনের জন্য মিরাজ (মিশকাত শরীফ)।
ফেরার পথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তিনি তাঁর উম্মতের নামাজ, রোজা সহ বিভিন্ন হুকুম, আহকাম নিয়ে আসেন। তাই মহানবী সা.-এর বিস্ময়কর মুজিজাকে হৃদয়ঙ্গম করে অবশ্যপালনীয় দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ফরজ ইবাদত তথা সকল হুকুম আহকাম পালনের মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভ করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের একান্ত জরুরী।
লেখক: এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
অনেক সুন্দর লিখেছেন মিরাজের ঘটনা, আলহামদুলিল্লাহ। ইন শা আল্লাহ ভবিষ্যতে আরও তথ্য উপাত্ত ও সহীহ হাদীসের আলোকে লিখবেন আশা করি।