|| প্রফেসর ড. মোঃ ময়নুল হক, ইবি, কুষ্টিয়া ||
আমার ছাত্রজীবনে সরকারী মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকাতে আলিম, ফাযিল ও কামিল ছয় বছরের সহপাঠী ছিলেন একজন রসিক বন্ধু হাফেজ কাজী সিরাজুল ইসলাম। তিনি ঢাবি থেকে সোস্যাল ওয়াল ফেয়ারের অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করে এখন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী।
একদিন বন্ধু আমাকে আমাদের দেশের বরেণ্য কথা সাহিত্যিক আবুল মুনসুর এর আয়না বইটি পড়তে দিলো। বইটি যতই পড়ছিলাম হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একটা গল্প পড়ে কিছুতেই হাসি থামাতে পারছিলাম না।
তখনকার দিনে পরিচিত গ্রুপ ছিলো মুহাম্মদী গ্রুপ, যারা আজকে আমাদের সমাজে আহলে হাদীস নামে পরিচিত। হানাফী ও মুহাম্মাদী গ্রুপদ্বয়ের দ্বান্দিক বিষয় সালাত বা নামাজে সূরা ফতিহার শেষ আয়াতে দল্লীন না যল্লীন উচ্চারণ হবে তা নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুনাযিরা বা বিতর্ক আয়োজন করা হয়েছে মাঠে সামিয়ানা টানিয়ে। বিতর্কের এক পর্যায়ে উভয় গ্রুপের মধ্যে সামিয়ানার বাঁশের খুঁটি তুলে পিটাপিটি শুরু হয়ে যায়। একজন লাঠি হাতে দৌড়াচ্ছে রাস্তায়, অপর প্রান্ত থেকে একজন সাধারণ পথচারী আসছে। লাঠিওয়ালা জিজ্ঞেস করছে ওই বেটা তুই দল্লীন না যল্লীন বল? পথচারী গোবেচারা থতমত খেয়ে বলছে আমি নামাজ ই পড়ি না।
আমরা এমনসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছি যা নফল্ মুস্তাহাব, বড়জোর সুন্নাহ। একজন নামাজ পড়ছে না তাকে ডেকে নামাজে নিয়ে আসার পরিবর্তে যে নামাজ পড়ছে তাকে বলছি তোমার নামাজ হচ্ছে না বা সহীহ হচ্ছে না। আমীন জোরে বলতে হবে যা নামাজে জোরে কিংবা আস্তে বলা মুস্তাহাব, কেউ না বললেও নামাজের কোন ক্ষতি হবে না।
সম্প্রতি একজন শায়খ বলেছেন, সাহাবার দেখানো নামাজ পড়লে সহীহ হবে না। কারণ একজন সাহাবা নামাজ আদায় করছিলেন, রাসূল সা. বললেন, তোমার নামাজ হয় নাই তুমি আবার পড়, এভাবে তাকে তিনবার শুধরালেন। এই হাদীস কী করে দলীল হয় সাহাবাদের শেখানো ও দেখানো নামাজ সহীহ নয়। উনি ইমাম বুখারী রহ.-এর নামাজ সহীহ ছিলো মনে করেন।
ইমাম বুখারী রহ একজন মুজতাহিদ মুহাদ্দিস ছিলেন, কিন্তু দুনিয়ার মানুষ তাকে মুহাদ্দিস বলেই জানে ফকীহ হিসেবে নয় বিধায় তাঁর ইজতেহাদ দ্বারা কোন মাযহাবী মাসলাক তৈরী হয়নি। উনার জন্মভূমি খোদ বোখারার জনগণ উনার ইজতেহাদ গ্রহণ করেননি, বরং বোখারার জনগণ ইমাম আবূ হানিফার মাসলাক মেনে চলতেন। তা ইমাম বুখারী রহ. জন্য ঈর্ষার কারণ ছিল এবং বলা হয়ে থাকে ক্বীলা বলা থার্ড পারসন হিসেবে উল্লেখ করা, ইমাম আবূ হানিফার নাম না নেয়া ঈর্ষাগত বিষয় ছিল।
অর্বাচীন শায়খের কাছে জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছে ইমাম বুখারী রহ. স্বচক্ষে রাসূল সা.কে নামাজ পড়তে দেখেছেন কী-না। সাহাবাদের শেখানো নামাজ সহীহ নয়, অথচ তাদেরকেই রাসূল সা. সম্বোধন করে বললেন, صلوا كما رأيتمونى أصلي তোমরা নামাজ সেভাবে পড়ো যেভাবে তোমরা আমাকে পড়তে দেখছো। خذوا عني مناسككم হাজ্জ আদায়ের পদ্ধতি আমার থেকে গ্রহণ করো। এখানে সম্বোধিত ব্যক্তি সাহাবা। অর্বাচীন শায়খ কিংবা ইমাম বুখারী রহ. নয়।
সাহাবারাই রাসূলুল্লাহ সা. কে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং রাসূল সা.এর শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ব্যতিক্রম যা, তাহলো সব সময় সব সাহাবা রাসূল সা. এর সাথে থাকতে পারেননি এবং রাসূল সা. এর সালাত আদায়ের পদ্ধতিতে কিছু বিষয় সব সময় একই রূপ ছিল না। ফলে শাখাগত বিষয়াদিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে, যা করা বৈধ।
এসব বিষয়াদিতে বাড়াবাড়ি না করার অনুরোধ রইল। সমাজটাকে অসহিষ্ণুতার হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব অন্তত নামধারী আলিম হলেও। আল্লাহ আমাদেরকে ফেতনার যুগে ফেতনার ফেরিওয়ালাদের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
লেখক: অন্যতম জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।