|| মেহেদী হাসান ||
জাতির নবযাত্রার এ সূচনালগ্নে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুভার দায়িত্ব গ্রহণ করায় নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান-কে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বরেণ্য এ শিক্ষাবিদ অতীতের যে কোনো উপাচার্যের চেয়ে নিঃসন্দেহে যোগ্যতম, যা তাঁর ব্যক্তিগত প্রোফাইল ঘাটলে সহজেই অনুমেয়। তাঁর পূর্বতন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার আলোকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা। আশাকরি, জাতির এ প্রত্যাশা পুরণে তিনি সফল হবেন।
তৎকালীন পূর্ব-বঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপটে। প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রাজনীতিও কখনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছু ছাড়তে পারেনি। ফলে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি পরবর্তী বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন, বাঙালি জাতির স্বায়ত্বশাসন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং সবশেষ ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান-এসবের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও লালনের ফলস্বরূপ উপর্যুক্ত ঘটনাবলি বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার নিঃসন্দেহে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এ রাজনীতিরই অপর পিঠে লুকায়িত এক অন্ধকারাচ্ছন্ন বাস্তবতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে বার বার কলুষিত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত অর্ধশতাব্দীতে প্রয়শই ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির যে বিকৃত রূপ আমরা ক্যাম্পাসে অবলোকন করেছি, তা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ বহুদিন যাবত অনুভূত হলেও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তা আলোর মুখ দেখতে পায়নি। গত ৫ আগস্টের অরাজনৈতিক ছাত্রনেতৃত্বের মাধ্যমে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থান সে সুবর্ণ সুযোগটি জাতির সামনে খুলে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীই ছিল উল্লিখিত দলীয় লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির চরম শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে, প্রশাসনে-সর্বত্রই তারা এ অপরাজনীতির দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিল। তারা আসলে এ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটির মাধ্যমেই তাদের মুক্তির উপায় খুঁজছিল। সে লক্ষ্যেই তারা জীবনপণ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুলির সামনে বুক পেতে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। তারা জানতো, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এ অন্ধকার দূরীভুত না হলে রাজনীতির এ দুষ্টচক্র থেকে জাতি কখনো মুক্তি পাবে না। সে কারণেই তারা বিগত সরকারের সামনে যে দাবিগুলো তুলে ধরেছিল, তার মধ্যে প্রধানতম দাবি ছিল-শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় রাজনীতি মুক্ত করা। কারণ ইতোপূর্বে অর্জিত বিরূপ অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির চর্চা অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ কখোনো ফিরে আসবে না। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের এ দাবির প্রতি লক্ষ রেখেই নবপ্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেশ সময় নিয়ে অনেক যাচাই-বাছাই করে দলনিরপেক্ষ একজন দক্ষ শিক্ষাবিদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়েছে; যদিও দলীয় পরিচয়ে পরিচিত বহু দক্ষ শিক্ষাবিদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বিদ্যমান। এক্ষেত্রে একটি যুক্তি অবশ্য বিরুদ্ধবাদীরা তুলতে পারেন, সেটা হচ্ছে- রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ কিভাবে ঘটবে? এতে করে কি জাতি ভবিষ্যতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। আর ক্যাম্পাসে রাজনীতি না থাকলে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ কারা করবে? এ প্রশ্নসমূহের মোক্ষম জবাব হচ্ছে- কোনো দলের লেজুরবৃত্তি না করেও যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ২০২৪-এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থান। এটি কোনো দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়নি। তার মানে, দলীয় ব্যানারে রাজনীতি না করেও রাজনৈতিক চেতনা ধারণ ও লালন করা যায়, এটা প্রমাণিত। আর দ্বিতীয় বিষয়টির জবাব হচ্ছে- প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের নেতৃত্ব দানকারী বর্গটির অভাব পুরণ করা যায়। এতে যেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক নেতৃত্বগুণ অর্জিত হবে, অপর দিকে জাতি লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ভবিষ্যত দক্ষ রাজনৈতিক প্রজন্মও খুঁজে পাবে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদসমূহে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রনেতারাই পরবর্তীতে দলীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে সুনমের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যকে “দলীয় রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন”-এর দাবির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের এ হৃদস্পন্দনকে অনুধাবন করতে হবে এবং সে চেতনাকে ধারণ করে তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষণাবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, শারীরিক ও মানসিক চাপমুক্ত শিক্ষাপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও সময়মতো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে স্বচ্ছতার সাথে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং যথাসময়ে তাঁদের পদোন্নতি দিতে হবে; এক্ষত্রে অযথা সময়ক্ষেপণ করে কাউকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এছাড়া হঠাৎ করে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন তাঁর সমীচীন হবে না, তেমনি কোনো গ্রুপের চাপে পড়ে যাকে তাকে যে কোনো পদে নিয়োগ দেয়া যাবে না। তাঁকে এ ব্যাপারে অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হবে এবং কোনো কারণে কারো ভয়ে ভীত হয়ে আপোস করা চলবে না। তাঁকে মনে রাখতে হবে, কোনো দলের অনুকম্পা কিংবা দয়া-দাক্ষিণ্যে তিনি এ আসনে আসীন হননি, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে তাঁর এ নিয়োগ- বহু লোভ-লালসা ও ভয়ভীতির আশংকা থাকা সত্ত্বেও পরম একনিষ্ঠতার সাথে জ্ঞান ও মণীষার সাধনা ও চর্চায় নিজেকে উৎসর্গের ফসল হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত এক মহা নিয়ামত, এ বিশ্বাস তিনি নিজ হৃদয়ে ধারণ করেন বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করে সেই মহাশক্তির উপর ভরসা রেখে নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে চললেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক উন্নত অবস্থানে পৌঁছতে পারবে, যা হয়ে থাকবে তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য এক অনন্য মাইলফলক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।