
|| বাপি সাহা ||
সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মাথায় রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে বিশ্বের প্রতিটি দেশ এগিয়ে চলেছে। উন্নয়নের প্রথম শর্ত নিজেদের স্বনির্ভরতা। বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মার্কিন শুল্কনীতি ইতিমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। মার্কিন শুল্কনীতির বিপক্ষে অনেক দেশ তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং ব্যবসায়িক নীতি একসাথে চালাতে গিয়ে মার্কিন অর্থনীতিকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনেকটা সমস্যার মধ্যে আছে মার্কিন অর্থনীতি।
মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ ভূমিকার ফলে গাজায় হত্যাকাণ্ড এবং ইরানে হামলার ঘটনায় বিশ্ব অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাশিয়া, চীন ও ভারত কিন্তু সকল প্রকার নৃশংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং একসাথে পথ চলার উদ্যোগ নিয়েছে। সাংবাদিকদেরও ছাড় দেয়নি ইসরায়েলি নৃশংসতা। গাজায় শিশু হত্যাসহ সকল প্রকার হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্র একমত—গাজায় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, শিশু ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
এই লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে তখন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফরে। তিনি আগামী ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করবেন। এই সফরটি দুই দেশের জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে, বিশ্বের জন্যও নতুন কোনো বার্তা বহন করছে। আফগান সরকারকে রাশিয়া প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন একমত, সেই সুরে সুর মিলিয়ে রাশিয়া-চীনের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও অনেকটা অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। অপেক্ষা করতে হবে, এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের ফলাফল কী হয়।
এবার আসা যাক মিগ-২১ ও তেজস প্রসঙ্গে:
অস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকটা ঘাম ঝরাতে হচ্ছে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের। ঠিক এই সময়টিতে ভারত মিগ-২১ থেকে তেজস যুগে প্রবেশ করেছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভারত মিগ-২১ থেকে তেজস যুগে প্রবেশ করেছে। তেজস ভারতীয় এয়ারক্রাফট প্রকৌশলীদের তৈরি প্রথম বিমান, যা বায়ুসেনার বহরে যুক্ত হয়েছে। ভারত তেজস যুগে প্রবেশের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করার লক্ষ্যে ভারতীয় বায়ুসেনায় যুক্ত করা হয়েছে তেজসকে। ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তায় স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদের যথাযথভাবে অবস্থান তৈরির জন্য তেজসকে সক্রিয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্থনীতির পাশাপাশি সাধারণ জনগণের কাছে স্বদেশী পণ্য ক্রয়ের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে তেজসের মাধ্যমে।
আহমেদাবাদের এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “স্বদেশী পণ্য ক্রয়ের ওপর জোর দিতে হবে।” ভারত মিগ-২১ ছেড়ে এখন তেজস যুগে প্রবেশ করেছে। ১৯৬৩ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে মিগ-২১ ক্রয় করার পর এটি ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। শব্দের চেয়ে অধিক গতিসম্পন্ন মিগ-২১। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে মিগ-২১ ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরের ভবনে মিগ-২১ থেকে বোমা বর্ষণ করে, এবং ঠিক তার পরের দিন পাকিস্তানি সেনারা ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে।
মিগ-২১ হলো একটি সোভিয়েত সুপারসনিক জেট ফাইটার বিমান, যা মূলত মিকোয়ান-গুরেভিচ ডিজাইন ব্যুরো দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল এবং এটি ফিশবেড নামেও পরিচিত। এটি ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ফাইটার বিমান। মিগ-২১ এর উন্নত সংস্করণ বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিগ-২১ একটি যুদ্ধবিমান ও ইন্টারসেপ্টর এয়ারক্রাফট। এর প্রথম উড্ডয়ন হয়েছিল ১৬ জুন, ১৯৫৫ সালে এবং প্রবর্তন করা হয় ১৯৫৯ সালে। এটি রাশিয়ার তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের বিমান। মূল ব্যবহারকারী দেশগুলো হলো সোভিয়েত এয়ারফোর্স, ভারতীয় এয়ারফোর্স এবং রোমানিয়া এয়ারফোর্স। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার বিমান তৈরি করা হয়েছিল।
অবসর নিচ্ছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর গর্বের মিগ-২১ যুদ্ধবিমান। বিদায়বেলায় বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি এই লড়াকু জেটটির সাফল্যের কাহিনী—যাকে রূপকথা বললে অতুক্তি হবে না। গত ২৬ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় বিমান ছাউনিতে “উড়ন্ত কফিন” উপাধি দিয়ে মিগ-২১ কে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন ভারতীয় বায়ুসেনার সদস্যরা। বিদায়ের কয়েকদিন আগেই শেষবার সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি নিয়ে আকাশে ওড়েন ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল অমরপ্রীত সিংহ। ককপিট থেকে নেমে আসার পর আবেগঘন ছিলেন তিনি।
মিগ-২১ ছিল প্রথম লড়াকু জেট, যার হাতে এফ-১০৪ স্টারফাইটারের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের “মৃত্যু” প্রতক্ষ্য করে বিশ্ব। লড়াইয়ে নিজেদের অজেয় তুলতে বিশেষ ধরনের একটি কামান নিয়ে উড়তে পারত ওই রুশ যুদ্ধবিমান। শত্রুর লড়াকু জেট ধ্বংসে এর ক্ষমতা ছিল প্রশ্নাতীত। মিগ-২১ এর কামানটির পোশাকি নাম ছিল জিএসএইচ-২৩, যা রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকরা তৈরি করেছিলেন। ৬২ বছরের কর্মময় জীবন মিগ-২১ এর।
এবার তেজসের কথা বলা যাক:
তেজস ভারতের তৈরি নিজস্ব প্রযুক্তির হালকা ওজনের মাল্টিরোল সুপারসনিক ফাইটার জেট, যার মধ্যে রয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমান প্রযুক্তির সব সুযোগ-সুবিধা। এক কথায় বলা যেতে পারে, এটি ভারতের উৎপাদনশীলতার প্রতীক। এটি ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তি ও নকশায় তৈরি যুদ্ধবিমান। তেজস হলো হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL) দ্বারা নির্মিত একটি ভারতীয় হালকা মাল্টিরোল ফাইটার জেট, যা ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। এটি ভারতীয় বায়ুসেনার মিগ-২১ এর মতো পুরোনো বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করেছে এবং কয়েকটি উৎপাদন ভেরিয়েন্ট (যেমন মার্ক-১) এ রয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ভারতীয় বায়ুসেনার আধুনিকীকরণ। তেজস প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ এটি ক্রয়ের আগ্রহ দেখাচ্ছে, যা ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তেজসের নামকরণ করেছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী; “তেজস” শব্দের অর্থ হলো “দীপ্তি”। আগামী কয়েক বছর ভারতীয় বায়ুসেনার স্কোয়াড্রনে যুক্ত হবে প্রায় ২২০টি তেজস। এর মধ্যে ১৭৩টি হবে এক আসনের এবং ৪৭টি হবে দুই আসনের প্রশিক্ষণ বিমান। এই প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৬৬ হাজার কোটি টাকার চুক্তি করেছে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL)-এর সঙ্গে। এক কথায় বলা যায়—দেশীয় প্রযুক্তির ফসল তেজস।
মিগ-২১ থেকে তেজস যুগে প্রবেশ করার মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে ভারতের পতাকাবাহী বায়ুসেনার বহর। তেজস যুক্ত হওয়ার ফলে ভারতীয় প্রকৌশলীদের তৈরি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এখন বাস্তব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আহমেদাবাদের এক জনসভায় বলেছেন স্বদেশী পণ্য ক্রয়ের বিষয়ে। মার্কিন শুল্কনীতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার জন্য স্বদেশী পণ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
রাশিয়ার কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি তেল ক্রয়ের মাধ্যমে ভারত রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে—এই অভিযোগের ভারত প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরিস্থিতির হিসাবনিকাশ করতে ভারত তার পুরোনো বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার কথা ব্যক্ত করেছে। চীনের সঙ্গে নতুন করে পথ চলার চিন্তাও দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-চীন-ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা ঘটছে। চেন্নাইয়ের পোশাক শিল্পের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভারত সরকার ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শুল্কনীতির বিরুদ্ধে অনেক দেশ সমঝোতা করলেও ভারত, রাশিয়া ও চীন কোনো প্রকার সমঝোতা করেনি। ভারত তেজস যুগে প্রবেশের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে তেজসে। নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করার লক্ষ্যে ভারতীয় বায়ুসেনায় যুক্ত করা হয়েছে তেজসকে। স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদের যথাযথভাবে অবস্থান তৈরির জন্য তেজসকে সক্রিয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে দিন যত যাচ্ছে, ততই পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথম কোনো তালেবান মন্ত্রী ভারত সফরে এসেছেন। এই সফরটি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। এই সফরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। যৌথ আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে, যা হয়তো অন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবাক করে তুলবে। তালেবান মন্ত্রীর এই সফর যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনভাবেই ভারতের এই তেজস যুগে প্রবেশও অনেক গুরুত্ব বহন করে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, ই-মেইল-sahabapi998@gmail.com, মোবাইল -01830-198550
