বুধবার, ডিসেম্বর ৩১

নতুন বছরে ইবি শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা

|| মোসাদ্দেক হোসেন | ইবি প্রতিনিধি ||

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ থেকে শীতকালীন ছুটি জনিত কারণে সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে; এর পরিণয়ে সকল শিক্ষার্থী বাড়িমুখী হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে ধূ-ধূ ফাঁকা অনুভূতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে এই ক্যাম্পাস, কনকনে শৈত্য প্রবাহে কোলাহল শূন্য হয়ে পড়েছে জিয়া মোড়, ডায়না চত্বর, ঝাল চত্বর সহ এই শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য প্রাঙ্গণ; ঝরে পড়ছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গার প্রবীণ আকাশচুম্বি সকল গাছের পাতা, হলের করিডোরে পায়ের শব্দ নেই, লাইব্রেরিতে বইয়ের পাতা ওল্টানোর আওয়াজ নেই, শাহ আজিজুর রহমান হলের পেছনের বা মেইন গেটের সামনের মেসপাড়ার যে জায়গাগুলো সবসময় শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো সেখানে এখন শুধুই নির্জনতা আর ধূসর শীতল কুয়াশার হাতছানি। কিন্তু তারপরও পরিবার আর মায়ের উষ্ণ ভালবাসার ছোঁয়া উপেক্ষা করে কেউ কেউ রয়ে গেছেন এই ফাঁকা, নিস্তব্ধ আর নির্জন শীতল ক্যাম্পাসে—কেউ বাস্তবতার কঠিন চাপে, কেউ দূরের বাড়ি যাওয়ার সামর্থ্য নেই বলে, আবার কেউ পড়াশোনা-চাকরির প্রস্তুতির জন্য। এই কনকনে শীতে তারা কী ভাবছেন নতুন বছর ২০২৬ নিয়ে? শুনুন তাদের কথা।

আইন বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান নতুন বছরকে আত্মসমালোচনা, দায়িত্বশীলতা ও পরিবর্তনের বছর হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ বছরের পথচলায় অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে অনিশ্চয়তা ও অসম্পূর্ণতার গল্প। নতুন বর্ষে পা রাখতে যাচ্ছি—এ এক স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রতিষ্ঠান, যা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং ইতিহাস-সংগ্রাম-গৌরবের সাক্ষী।গুচ্ছভুক্ত হওয়ার পর ২০২০–২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী বৈচিত্র্য বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা এসে শিক্ষা-সংস্কৃতি-চিন্তার পরিসর বিস্তৃত করেছে। এ বৈচিত্র্য যদি সঠিকভাবে ধারণ করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় আরও সমৃদ্ধ হবে।
কিন্তু বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে আমরা এখনো ভিন্নমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারিনি। সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে ঘিরে মতাদর্শিক সংঘর্ষ সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন। নতুন বছরে প্রথম প্রত্যাশা—ভিন্নমতকে শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

অবকাঠামোর সংকটও গুরুতর। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় সহশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ছাত্রীদের জন্য আরও হল এবং মেসে নিরাপত্তা-ভাড়া নিয়ন্ত্রণে তদারকি কমিটি জরুরি।শিক্ষার মান বাড়াতে গবেষণা উৎসাহিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক জোরদার করা দরকার। এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক সংযোগ ও স্কলারশিপ সহায়তা বাড়াতে হবে। AI যুগে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্টুডেন্ট সার্ভিস চালু করা এখন অপরিহার্য।
২০২৬-এর নববর্ষে এসব প্রত্যাশা অলীক নয়—এগুলো সময়ের দাবি।

ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী সুনভির নিশান বলেন, “২০২৬ হোক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন, আশা ও নতুন উদ্যমের বছর। আমরা চাই ক্যাম্পাস হোক আরও শিক্ষার্থী-বান্ধব, শান্তিপূর্ণ, আধুনিক ও গবেষণামুখী। নতুন বছরে জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধে আমরা আরও সমৃদ্ধ হবো এই অঙ্গীকারেই এগিয়ে যাক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। শুভ নববর্ষ ২০২৬ I”

ফলিত খাদ্য এবং পুষ্টি প্রযুক্তি বিভাগের একই সেশনের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান আরব, বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবনার স্বাধীন ভূমি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ” নতুন বছর ভবিষ্যৎ ঘোষণা করে না, ভবিষ্যৎ গড়ার দায় আমাদের হাতে তুলে দেয়।
ইংরেজি নববর্ষ ২০২৬ সেই দায় নিয়েই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞান বিতরণ করে না, চিন্তার শৃঙ্খল ভাঙে।

এখানে প্রশ্ন করাই প্রথম সাহস, সংশয়ই বুদ্ধিবৃত্তিক সততা।
আমরা চাই এমন শিক্ষা, যা সিলেবাসের সীমা ছাড়িয়ে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে।
যেখানে ডিগ্রি নয়, গভীরতা মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে।”

আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী দিপু চন্দ্র রায় বলেন, ইংরেজি নববর্ষ ২০২৬ আমার কাছে নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা আর ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠুক। এই বছরে আমি চাই নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে আরও শৃঙ্খলিত ও লক্ষ্যভিত্তিক করতে। পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়ে নিজের দক্ষতা, জ্ঞান ও যোগ্যতা বাড়াতে চাই। পারিবারিক জীবনে শান্তি, ভালোবাসা ও একতার বন্ধন আরও দৃঢ় হোক এটাই আমার প্রত্যাশা। সমাজের দিকে তাকালে চাই আমরা যেন আরও মানবিক হই এবং অন্যের সুখ–দুঃখে পাশে দাঁড়াই। দেশ হিসাবে আমরা যেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাই এবং দুর্নীতি, সহিংসতা ও বিভাজনের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকতে পারি। এটাই আমার বড় স্বপ্ন। পাশাপাশি চাই বিশ্ব যেন যুদ্ধ, সঙ্কট ও ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি ও সহাবস্থানের পথে এগিয়ে যায়।দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। সর্বোপরি, ২০২৬ সাল হোক সবার জন্য সুস্থতা, সফলতা, নিরাপত্তা ও সুখের বছর এই আমার আন্তরিক আশা ও প্রত্যাশা

ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের, ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী শ্রাবণী আক্তার বলেন,
২০২৫-এর শেষ পাতা ঝরে পড়তেই আমরা পা রেখেছি ২০২৬-এর নতুন ভোরে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে কুয়াশার মধ্যে উঠে আসা প্রথম সূর্য যেন নতুন সম্ভাবনার বার্তা বয়ে এনেছে।
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে নববর্ষ আমার কাছে কেবল উৎসব নয়, বরং অতীতের হিসাব মেলানো এবং ভবিষ্যতের পথরেখা আঁকার সুযোগ। ২০২৬-এ আমার প্রধান চাওয়া—গবেষণামুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, যাতে আমরা সনদের পেছনে না ছুটে প্রকৃত জ্ঞানে সমৃদ্ধ হই এবং বিশ্বমঞ্চের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি।
তরুণ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের অঙ্গীকার হোক—সহনশীলতা, স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব এবং প্রযুক্তির কল্যাণকর ব্যবহার। পৃথিবী হোক যুদ্ধমুক্ত, জলবায়ু সচেতনতা বাড়ুক, দেশ সবুজে ভরে উঠুক।পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আশার আলোয় এগিয়ে যাই। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী ও দেশবাসীকে জানাই ইংরেজি নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ ২০২৬।

একই বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী সৃষ্টি পাল বলেন, নতুন বছর মানেই আমার কাছে সবকিছু একটু অন্যরকম বা নতুন করে চিন্তা করা। যদিও সবসময় নতুন করে ভাবা সম্ভব হয়না। কিন্তু যখন একটা বছর শেষ হয়ে আবার একটা নতুন বছর শুরু হয়, তখন মনে হয় গত বছরের ভুল, হতাশাগুলোকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথমেই চাই নতুন বছরের সাথে সাথে পড়াশোনাটা আরও ভালোভাবে গুছিয়ে করার, রেজাল্ট এর মান উন্নত করার, কিছু নতুন স্কিল ডেভেলপমেন্ট করার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সঠিক ব্যবহার করার কারন আমার মতো অনেক শিক্ষার্থীরই প্রোক্রাস্টিনেশনের সমস্যা রয়েছে বলে আমি মনে করি। সবমিলিয়ে আমার কাছে নতুন বছর মানে নিজেকে আরেকটু বেশি গুছিয়ে পরিপাটি করা, দায়িত্বশীল হওয়া এবংপরিশ্রমী হওয়া।

ফলিত খাদ্য ও পুষ্টি প্রযুক্তি বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের আরেক নারী শিক্ষার্থী বলেন, “স্বপ্ন বড় হতে পারে, কিন্তু শিক্ষা দুর্বল হলে ভবিষ্যৎ দাঁড়ায় না।নববর্ষ ২০২৬-এ একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এটিই আমাদের সবচেয়ে গভীর উপলব্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কোনো জটিল বা অসম্ভব কিছু নয়। আমরা চাই শুধু কয়েকটি মৌলিক বিষয়:
নিয়মিত ও সময়োচিত ক্লাস, যাতে জ্ঞানার্জন অবিচ্ছিন্ন থাকে।মানসম্মত শিক্ষা এবং ন্যায্য, স্বচ্ছ মূল্যায়ন ব্যবস্থা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও উন্মুক্ত যোগাযোগ।সেশনজটমুক্ত কার্যক্রম এবং দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা, যা আমাদের বিশ্বমঞ্চের জন্য প্রস্তুত করবে।
এই সাধারণ দাবিগুলো পূরণ হলে নতুন বছর আমাদের জন্য সত্যিই সার্থক হবে। আমরা তখনই স্বপ্ন দেখতে পারব বড় করে, যখন শিক্ষার ভিত মজবুত হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান—আসুন ২০২৬-কে শিক্ষার মানোন্নয়নের বছর করি, শুভ নববর্ষ ২০২৬!”

উল্লেখ্য, রবিবারে (৫ জানুয়ারি ২০২৬) শীতকালীন ছুটি শেষ করে পরদিন সোমবার (৬ জানুয়ারি) থেকে নতুন বছরের সকল একাডেমিক কার্যক্রম চালু করবে এ বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *