বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯

টঙ্গীতে তীব্র গ্যাস সংকট : অবৈধ সংযোগে জনজীবন ও শিল্পকারখানায় চরম দুর্ভোগ

|| গাজীপুর প্রতিনিধি ||

গাজীপুরের টঙ্গীতে চলমান গ্যাস সংকট এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সিএনজি পাম্পে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কারণে গ্যাসের চাপ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এতে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে শিল্পখাত পর্যন্ত ভোগান্তিতে পড়েছে। টঙ্গীর আফতাব সিএনজি পাম্প, আলম এশিয়া সিএনজি পাম্প ও মার্কো সিএনজি পাম্পসহ একাধিক স্থানে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সংযোগের কারণে পুরো শহরজুড়ে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, এরশাদনগর এলাকার আলম এশিয়া সিএনজি পাম্পসহ বেশ কিছু বড় পাম্পে গ্যাস পাইপলাইন থেকে সরাসরি সংযোগ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা চলছে। এসব পাম্পের ভেতরে একেকটি কাবার্ট ব্যান্ডে ৫০ থেকে ৭০টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়। প্রতিটি সিলিন্ডারে প্রায় লাখ খানিক টাকার গ্যাস ভর্তি করা হয়। এভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ গ্যাস মজুত ও বিক্রি করা হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে এসব সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এমন দুর্ঘটনা ঘটলে আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে এবং ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে আলম এশিয়া সিএনজি পাম্পের ম্যানেজার নূরুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিককে ছবি তুলতে বাধা দেন এবং হুমকি দিয়ে বলেন, “আমরা গ্যাস নিয়ে ব্যবসা করছি, আপনি পারলে কিছু করুন।” তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য শুধু অবৈধ ব্যবসার দৃষ্টান্তই নয়, বরং প্রশাসনিক অবহেলারও প্রতিফলন। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

গ্যাসের সংকটে টঙ্গীবাসীর ভোগান্তি এখন চরমে। সকালবেলায় রান্নার সময় গ্যাসের প্রেসার না থাকায় খাবার তৈরি করতে পারছেন না অনেক গৃহিণী। স্থানীয় বাসিন্দা রুনা বেগম বলেন, “সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের নাস্তা বানাতে পারি না। অনেক সময় বাচ্চারা না খেয়েই স্কুলে চলে যায় গ্যাস না থাকার কারণে।” এ অবস্থায় দিন দিন নাগরিক জীবনে নেমে আসছে চরম অসুবিধা। রান্না থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজকর্মে ভোগান্তির শেষ নেই।

গ্যাস সংকটে শিল্পখাতও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টঙ্গীর বিসিক শিল্পাঞ্চলের উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাসের প্রেসার না থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে এবং অর্ডার সময়মতো পাঠানো যাচ্ছে না। হামিম গ্রুপের ম্যানেজার মো. কায়েস বলেন, “গ্যাসের প্রেসার না থাকার কারণে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক শিপমেন্ট ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে, কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে।” শিল্পাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের মতে, গ্যাসের প্রেসার সাধারণত ১৫ পিএসআই থাকার কথা, কিন্তু এখন তা ১২ কিংবা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে শিল্পকারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর শিপমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের টঙ্গী অঞ্চলের ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। তবে একটি দুষ্টচক্র পুনরায় এসব সংযোগ স্থাপন করে। যদি তিতাসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এতে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—যদি নিয়মিত অভিযান হয়, তবে অবৈধ সংযোগগুলো পুনরায় স্থাপিত হচ্ছে কীভাবে? এতে প্রশাসনের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এ অবস্থায় টঙ্গীর সাধারণ মানুষ ও শিল্পকারখানাকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ সংযোগগুলো চিহ্নিত করে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং দায়ীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে তিতাস গ্যাস, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

টঙ্গীর গ্যাস সংকট এখন কেবল একটি সরবরাহ সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনলে জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়বে এবং শিল্পখাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই এখনই সময়, অবৈধ সংযোগ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে টঙ্গীবাসীর স্বস্তি ফিরিয়ে আনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *