বুধবার, নভেম্বর ২৬

কেন ভেস্তে গেল পাক-আফগান শান্তি আলোচনা

অনেকটা আশা জাগিয়ে ভেস্তে গেল পাক-আফগান শান্তি আলোচনা। কার কতটুকু লাভ হলো সেই হিসাব দুই দেশের রাজনীতিবিদদের। শান্তি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির সুযোগে হয়তো নোবেল পুরস্কারও ফোকাসে যেতে পারে রাষ্ট্রনায়কদের।

যুদ্ধ আমাদের কাম্য নয়, কারণ যুদ্ধ সবসময় ধ্বংস ডেকে আনে। গাঁজায় ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তনাদ আর মায়ের কান্না দূরদেশ থেকে এখনও ভেসে আসে। গাঁজা কিন্তু শান্ত হয়নি। শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ছাড়া আর কী দিতে পারব আমরা? যুদ্ধ আমরা চাইনি, কিন্তু যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় নিজেকে লড়তে হয়।

যাই হোক, রাতের শুকতারার মতো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল পাক-আফগান শান্তি আলোচনা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আফগানরা পাকিস্তানকে দোষারোপ করলেও পাকিস্তান তা মানতে রাজি নয়। সীমান্তে আবারও বিমান হামলা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব এখন দুই ভাগে বিভক্ত। পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আকর্ষিত হলেও চীনকে ছাড়তে চাইছে না—কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে নিজের নিরাপত্তা। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আফগানিস্তান অনেকটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্র তাদের অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। মার্কিন হুমকি আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি দখলের পরিপ্রেক্ষিতে আফগানদের শক্ত অবস্থান আরও দৃঢ় হয়েছে। তালেবান সরকার গঠনের পর রাশিয়ার স্বীকৃতি তাদের জন্য একটি বড় পাওয়া।

আলোচনার সাথে যুক্ত করে বলতে হয় ভারত কিন্তু চীনের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িত হবার পর রাজনীতির মেরুকরণ দ্রুত হয়েছে। একটু বলতেই হয়—বিক্রম মিশ্রি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালনকাল থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন এই মানুষটি। তিনি বিনয় মোহন কোয়াত্রার উত্তরসূরি হিসাবে এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি এর আগে ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বেইজিংয়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং কূটনৈতিক মহলে “চীন বিশেষজ্ঞ” হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল বেইজিংয়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক অনেকটা ভালো—যার কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে মার্কিন শুল্কনীতি, যা “শাপে বর” হিসাবে ভারতের জন্য।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে শান্তি আলোচনায় শেষ মুহূর্তে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার জানিয়েছেন, ইস্তাম্বুল আলোচনা ভেঙে গেছে। এই আলোচনা চলাকালে পাকিস্তান–আফগান সীমান্তে বিমান হামলা করেছে, যা আফগান সরকার নিন্দা প্রকাশ করেছে। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনার অচলাবস্থার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ বড় ভাই এরদোয়ান। তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্তাকি ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একই সাথে তালেবান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। একজন দক্ষ কূটনীতিক হিসাবে তিনি তার যোগ্যতার বলে বিশ্বে অনেকটা সমাদর পেয়েছেন—যার প্রমাণ রাশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক।

আফগান–পাকিস্তান শান্তি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার একটি কারণ হিসাবে বলা হয়ে থাকে রাশিয়া, চীন ও ভারতের জোটের সাথে আফগানিস্তানের নিবিড় সম্পর্ক। রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন, ব্যাপক সমর্থন তাদের শক্তি ও সাহসকে করেছে বৃদ্ধি। নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার বিষয়ে তারা গভীরভাবে মনোযোগী। পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থন থাকলেও সেটি কতটুকু জোরালো, সেটি কিন্তু ভাবতে হবে। মার্কিন রাজনীতি অনেকটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিরসনে ব্যস্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার গঠিত হবার পর নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন—নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। পাকিস্তান বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে বৃদ্ধি করতে মনে হয় ব্যর্থ হয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার জন্য। আফগান রাজনীতিতে তারা তাদের ক্রিকেট কূটনীতিকেও সফলভাবে স্থাপন করতে পেরেছে।

এই লেখাটি যখন সমাপ্তির পথে তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটি সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, “বন্ধু পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না।” ভারত তার প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পথ চলতে চায়। আফগানিস্তানের পাশে থেকে তার উন্নয়নে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল গণমাধ্যমকে বলেছেন, “আফগানিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় তারা একে অপরের পাশে আছে।” সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বের আস্থা অর্জন আফগানিস্তানকে করেছে শক্তিশালী।

দিন বদলের সাথে সাথে ভূ-রাজনীতি পরিবর্তন হচ্ছে। ভূ-রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক (খুলনা)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *