
|| বাপী সাহা ||
বছর জুড়ে যে মানুষটি আলোচিত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সমালোচিত হয়েছেন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। বেশ কিছু ইস্যুতে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বছর শেষে আবারও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন অভিবাসী বিষয়ে। অভিবাসীদের ধরে নিয়ে তিনি গুদামঘরে রাখবেন। এর জন্য বড়সড় কিছু গুদামঘর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। খোদ মার্কিন মূলুকে এই সিদ্ধান্ত ঘিরে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মানুষকে গুদামে রাখার সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবসম্মত—সেটি ভাবতে হবে। এটি কোন মানবিকতা, সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।
মানবিকতার প্রশ্ন যখন চলে আসে, তখন ভাবতে হবে দেশের কথা। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার ঘরে তালা দিয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি কি মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে একজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে? পোড়া মৃতদেহের গন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আমাদের সকলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ছোট মেয়েটির পর বড় মেয়েটিও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের শয্যায় পোড়া দেহ নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। কী অপরাধ ছিল তাঁদের? সেই প্রশ্নের উত্তর কি কোনোদিনও পাওয়া যাবে? যার যায়, সেই বোঝে তার কী গেল।
মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে দীপু চন্দ্র দাস-এর মৃত্যুর কি কোনো উত্তর আছে? সেটির কোনো উত্তর আছে কি? আগুন যেন আমাদের সব মানবিকতা কেড়ে নিচ্ছে। দীপু চন্দ্র দাস বাংলাদেশের নাগরিক—এই বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে? দীপু চন্দ্র দাস-এর শিশু সন্তান রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করে—আমি কেন পিতাকে হারালাম? রাষ্ট্রের এই প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে কোনো উত্তর কি দিতে পারব আমরা? বাতাসে লাশের গন্ধ আমাদের জীবনকে যেন অস্থির করে তুলেছে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে দীপু চন্দ্র দাসকে। তাঁর শিশু পুত্রের কাছে আমাদের কী সান্ত্বনা রয়েছে? সামান্য একজন গার্মেন্টস কর্মীর স্বপ্ন ছিল পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকা। স্বপ্ন দেখাটাই কি অপরাধ!
অনেকটা হতাশা নিয়ে লেখাটি উপস্থাপন করতে হচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, বিশ্বশান্তি রক্ষায় যে দেশটির ছয়জন শান্তিরক্ষী সুদানে এই বিজয়ের মাসে প্রাণ দিয়েছেন—সেই বিজয়ের মাসেই সেই দেশটির স্বাধীন মত প্রকাশের দুটি দৈনিক পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর অফিসে যে নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছে, অবরুদ্ধ করা হয়েছে কলমসৈনিকদের। হয়তো দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারত। এই ঘটনা ঘটেছে বিজয়ের মাসেই।
বিজয় প্রাপ্তির ৫৪ (চুয়ান্ন) বছরে পত্রিকায় হামলার ফলে পরের দিন পত্রিকা বন্ধ রয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের প্রকাশনা জীবনে এটি মনে হয় প্রথম। শুধু হামলাই নয়, লুটপাট করা হয়েছে সম্পদের। একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরের কী অপরাধ ছিল যে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো? বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে বীভৎসতা কাকে বলে। সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই শিউরে উঠেছেন প্রাণের প্রতিষ্ঠানের এই করুণ চিত্র দেখে। মত প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো সংবাদপত্র।
দেশ এখন নির্বাচনী ট্রেনে। নির্বাচনকে প্রাণবন্ত করতে গেলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সংবাদপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্র যাতে করে সেই ভূমিকা পালন করতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই এই হামলা। কলমসৈনিকদের থামিয়ে দেওয়ার একটি মহাপরিকল্পনা। মব তৈরি করার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ চলমান কার্যক্রমকে ব্যাহত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে অনেক আগ থেকেই, যার একটি নরকীয় উদাহরণ এই হামলা।
দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করে আসছে। দালালির তকমা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এই আয়োজন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ সকল সংবাদপত্র বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বলে, বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করে। আমরা সকল প্রকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাই এবং দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের দাবি জানাই।
আগুনে পুড়েছে ছায়ানট ও উদীচী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। মানুষের কথা বলা, মানবিকতার কথা বলাটা কি অপরাধ? গণমাধ্যম সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরে—সেটা কি অপরাধ? আগুন দিয়ে তারা চুপ করাতে পারেনি।
হামলাকারীদের উদ্দেশ্য কী ছিল—লুটপাট করাই কি উদ্দেশ্য, নাকি গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করাই লক্ষ্য—তা খুঁটিয়ে দেখতে হবে। গণমাধ্যম যেন হুমকির শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের সকল অর্জন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্র।
আমাদের দেশের উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করলে অকৃতজ্ঞ হতে হয়। সংবাদপত্রসেবীরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা উপস্থাপন করেন, সেটি আমাদের মনে রাখতে হবে। গণতন্ত্র রক্ষায় গণমাধ্যম সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে এসেছে।
সকল হামলা, হত্যা ও সন্ত্রাসের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান। কাউকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে কল্পনার রং দিয়ে ছবি এঁকে বিভৎস আচরণের নাম প্রতিবাদ হতে পারে না। মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে গণমাধ্যমকে আক্রমণ করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা আমাদের ভাবতে হবে। যারা মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলে, তাদের অধিকারের কথা কে বলবে—সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা কথা বলে, তাদের জন্য এই হামলা কী বার্তা বহন করে—সেটি ভাবার সময় এসেছে। সভ্যতা ধ্বংসের একটি প্রক্রিয়া হলো মত প্রকাশের অধিকার ধ্বংস করা।
এই হামলার পরেও থেমে থাকেনি প্রকাশনা। কলমসৈনিকেরা বসে নেই। প্রবহমান নদীর স্রোতধারার মতো চলছে তাঁদের যাত্রা। আমরা প্রত্যাশা করি এই যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে।
হামলার শিকার হয়েছে ছায়ানট ও উদীচী। ছায়ানট পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গানে গানে প্রতিবাদ জানিয়েছে। রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালির ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে। উদীচী গণমানুষের কথা উপস্থাপন করে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছে—গানে, নাটকে সাধারণ মানুষের কথা বলেছে।
শান্তির নগরী খুলনায় মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও শান্তির নগরীতে যখন অশান্তি বিরাজ করে, তখন ভাবনাটা এসে যায়। বেশ কয়েকটি ঘটনা শান্তির নগরীতে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। প্রশাসন তৎপর থাকা সত্ত্বেও লাগামহীনভাবে চলছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম।
এই সকল ঘটনার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে মাদক—মাদকের অবৈধ ব্যবহার। কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য বেড়েছে। নগরীতে কিশোর গ্যাং-এর সর্বশেষ মহড়া আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সর্বশেষ যে ঘটনাটি খুলনাবাসীকে অবাক করেছে, তা হলো মাদক এখন রাজনীতিকেও স্পর্শ করেছে।
রাজনৈতিক দলের সদস্যরা যদি মাদকদ্রব্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তবে সেটি কি আমাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত? এনসিপির অঙ্গ সংগঠন শ্রমিক শক্তির বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক মোতালেব মাদকসংক্রান্ত ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত মোতালেব শিকদার সোনাডাঙ্গা শেখপাড়া পল্লী মঙ্গল স্কুল এলাকার মৃত মোসলেম শিকদারের ছেলে।
এই ঘটনায় খুলনা জেলা যুবশক্তির যুগ্ম সদস্য-সচিব মোসা তানিমা ওরফে তম্বীকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তাঁরা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন এবং নিজেদের মধ্যে কোন্দলের কারণেই গুলির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত বলে স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মাদক সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে পড়া দুঃখজনক। আমরা মাদকমুক্ত সমাজ চাই। কিন্তু যুবশক্তি যদি মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে সমাজের কাঠামো যে ভেঙে পড়বে—এটি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
এই লেখাটি যখন সমাপ্তির পথে, তখন র্যাব-৬-কে ধন্যবাদ জানাতে হয়। মোতালেবকে গুলি করা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানা গেছে, চাহিদামতো মাদক সরবরাহ না করায় এই ঘটনা ঘটেছে। মানুষের প্রত্যাশা কি শুধু প্রত্যাশাই থেকে যাবে?
হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত পলাতকদের সহায়তাকারী দুইজনকে মেঘালয়ে ভারতীয় প্রশাসন গ্রেপ্তার করেছে—এই তথ্য জানিয়েছে ডিএমপি।
পরিশেষে আশার বাণী দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানছি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন। তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেছেন। প্রত্যাশায় দলীয় কর্মীরা বুক বেঁধেছেন। দেশবাসীও প্রত্যাশা করছে অনেক।
ভাঙা সম্পর্কগুলোকে নতুন করে টেকসই বন্ধনে আনতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বহুদূর। শিল্প-বাণিজ্যে মন্থর গতি কাটিয়ে আনতে হবে সচল অবস্থা। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে সরে আসতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা অনেক, স্বপ্নও অনেক।
বড়দিনের উৎসবে তাঁর এই আগমন হয়তো আমাদের প্রাপ্তির ঝুড়িতে অনেক প্রত্যাশিত ফল যোগ করবে। নতুন বছরটি হোক সম্ভাবনার বছর।
লেখক: আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী (খুলনা)।
