
|| পরিমল পালমা ||
উন্নয়ন খাতে বিদেশি সহায়তা ক্রমাগত কমতে থাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তাকারী এনজিওগুলোর কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশকে বিকল্প তহবিলের উৎস খুঁজতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা পেলেও ধারাবাহিকভাবে তা কমছে। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশটির এনজিওগুলো ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা পেয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৬ শতাংশ কম।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে বিকল্প অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, আগামী বছরে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ, নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের ইউএসএআইডি কার্যক্রম স্থগিতের সিদ্ধান্ত এবং ২০২৮ সালের পর বাংলাদেশে অর্থায়ন বন্ধে সুইজারল্যান্ডের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে এ চ্যালেঞ্জ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে, যেখানে প্রায় ১০০টি প্রকল্পের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া যেত। রাতারাতি হাজারো উন্নয়নকর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনীয় পরিষেবার আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইসিডিডিআর,বি তাদের এক হাজারের বেশি কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোর জরুরি খাদ্য সহায়তা ছাড়া সব ধরনের সেবা স্থগিত করা হয়েছে।
এনজিওগুলোর শীর্ষ সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশের পরিচালক এ কে এম জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ করে তহবিল স্থগিতের বিষয়টি গভীর উদ্বেগের।’
এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৪৯৮টি, যার মধ্যে ২৪০টি বিদেশি এবং বাকি সব স্থানীয়। তবে অন্যান্য হিসাব মতে এখানে ২৭ হাজার এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এনজিওগুলো সেই সব ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে যেখানে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপ নেই। এইভাবে, এনজিওগুলো সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
যে কোনো সরকারই বিদেশি সহায়তা সম্পর্কিত নীতি পরিবর্তন করতে পারে।
‘ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আমাদের সরকারকে আরও তহবিলের জন্য প্রধান উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, তবে একই সঙ্গে এনজিওগুলোর জন্য তহবিলের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে এবং তারা যেন টিকে থাকতে পারে তার জন্য সাহায্য করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় কাজ করে কোস্ট ফাউন্ডেশন। এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, ব্র্যাক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ তুলে ধরে এনজিওগুলোর টিকে থাকার জন্য ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্র্যাকের ১৩টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের অন্তত ১০টি সামাজিক ব্যবসা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোস্ট ফাউন্ডেশনও মূলত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, ‘বিদেশি তহবিলের উপর নির্ভর না করে আমাদের টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। কখনো কখনো বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভর করা অপমানজনক।’
তার মতে, বিদেশি সহায়তার বড় একটি অংশ পরামর্শক এবং সংশ্লিষ্ট দাতা দেশের বিদেশি নাগরিকদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোও বিদেশি তহবিল দিয়ে প্রকল্প পরিচালনা করার সময় তাদের ওভারহেড খরচ অনেক বেশি হয়, তিনি বলেন।
‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এটি উন্নত করার জন্য কথা বলে আসছি, কিন্তু হচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে বিদেশি অর্থায়নের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু অনেক সময় বিদেশি সাহায্যভিত্তিক প্রকল্পগুলো অ্যাডহক ভিত্তিতে হয় এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হয় না।
যেহেতু সাহায্য হ্রাস পাচ্ছে, তাই সরকারের কিছু মৌলিক বিষয়ের উপর মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং কর্মসংস্থানযোগ্য চাকরির জন্য যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
তিনি বলেন, দেশে ও বিদেশে আমাদের জনশক্তির একটি বিস্তৃত বাজার তৈরি হতে পারে। তারপরে, আমরা তাদের সেই অনুযায়ী প্রশিক্ষণ এবং তাদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করতে পারি। এতে আমাদের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে।
এনজিওগুলোর জন্য বিদেশি অর্থায়নের বিকল্প হতে পারে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) হিসেবে কর্পোরেটদের বরাদ্দকৃত তহবিল।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই তাদের নিজস্ব ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্টের জন্য সিএসআর তহবিল ব্যবহার করে, কারণ সিএসআর তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্পষ্ট কোনো নীতি নেই, বলেন জসিম উদ্দিন। তিনি সিএসআর তহবিলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দেন।
সূত্র: দি ডেইলি স্টার (বাংলা)