
স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর এক মেধাবী তরুণের নীরব প্রস্থান
|| কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ||
রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রংপুর শহরের আকাশটা তখন আর দশটা দিনের মতোই ছিল। চারপাশে ব্যস্ততা, মানুষজনের চলাচল—কেউ জানত না, ঠিক ওই সময়েই এক তরুণের বুকভরা স্বপ্ন চিরতরে নিভে যাচ্ছে। নাম তার নীরব—কুড়িগ্রামের এক শিক্ষক দম্পতির মেধাবী সন্তান, যার চোখে ছিল চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন।
নীরব ছিল চুপচাপ, ভদ্র, পড়াশোনায় মনোযোগী। পরিবারের সব প্রত্যাশা, আত্মীয়স্বজনের গর্ব আর নিজের ভবিষ্যৎ—সবকিছু মিলিয়ে তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়াটা নীরবের কাছে শুধু একটি ব্যর্থতা ছিল না, ছিল নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধের পরাজয়।
রংপুর শহরের একটি ছাত্রবাসে থাকত নীরব। সহপাঠীরা জানায়, কয়েকদিন ধরে তাকে খুব চুপচাপ লাগছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলত না। চোখেমুখে ছিল চাপা কষ্ট, অথচ মুখে কিছু বলত না—নামটার মতোই নীরব।
রবিবার সন্ধ্যায় সে বাসা থেকে বের হয়। কেউ ভাবেনি, সেটাই হবে তার শেষ হাঁটা। বাসা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে সে এমন এক সিদ্ধান্ত নেয়, যা কোনোভাবেই ফেরানো যায়নি। মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় একটি তরুণ জীবন—পেছনে রেখে যায় অসীম শূন্যতা।
নীরবের বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চিলমারী এলাকায়। বাবা এরশাদুল হক ও মা নুরুন্নাহার বেগম—দুজনেই শিক্ষক। অন্যদের সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব যাঁরা আজীবন পালন করেছেন, সেই মানুষ দুজনই নিজের সন্তানের জীবন রক্ষা করতে পারলেন না—এই বেদনা ভাষায় প্রকাশের নয়।
গ্রামে নীরবের খবর পৌঁছাতেই নেমে আসে শোকের ছায়া। প্রতিবেশীরা বলছেন, “ছেলেটা খুব ভালো ছিল, ভদ্র ছিল। কখনো কল্পনাও করিনি এমন কিছু হবে।” শিক্ষকরা বলছেন, নীরব ছিল সম্ভাবনাময়—চাইলে জীবনের অন্য পথেও সে সফল হতে পারত।
এই মৃত্যু আবারও সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে এক কঠিন বাস্তবতা—একটি পরীক্ষার ফল কীভাবে একটি তরুণের জীবনের সব অর্থ হয়ে ওঠে। সমাজের প্রত্যাশা, পরিবারের স্বপ্ন আর নিজের ওপর চাপ—এই ত্রিমুখী বোঝা অনেক সময় তরুণ মন সইতে পারে না।
নীরবের চলে যাওয়া শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়, এটি আমাদের সমাজেরও ব্যর্থতার গল্প। যেখানে আমরা ফলাফলকে মানুষ হওয়ার মাপকাঠি বানিয়ে ফেলি, সেখানে জীবনটাই হারিয়ে যায়।
নীরব আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তার গল্প যেন আর কোনো নীরবের জীবনে পুনরাবৃত্তি না হয়—এই উপলব্ধিটুকুই হতে পারে তার প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা।
