|| প্রফেসর ড. আ ব ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, ইবি, কুষ্টিয়া ||
আল কুরআন নিছক কোন ধর্মীয় গ্রন্থ নয়। সাথে সাথে বিশ্বের সর্বাধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানেরও উৎস গ্রন্থ। এজন্য আল কুরআনের আবেদন সর্বকালে সর্বযুগে একই সমান।
দুধ পরিচিতি
স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুগ্ধ গ্রন্থি হতে নিঃসরিত এক প্রকার তরল পদার্থ হল দুধ।
দুধ হল স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্তন্যগ্রন্থি থেকে উৎপাদিত অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এক প্রকার সাদা তরল পদার্থ । এটি শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল মানুষের একটি প্রধান খাদ্য।
দুধকে আরবিতে বলা হয় লাবান (لبن)। লাবান (لبن) শব্দটি আল-কুরআনে দু স্থানে এসেছে -সূরা নাহলের ৬৬ নং আয়াতে এবং সূরা মুহাম্মদের ১৫ নং আয়াতে।
অন্যান্য খাদ্যগ্রহণে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত স্তন্যপায়ী শাবকদের এটিই পুষ্টির প্রধান উৎস। স্তন থেকে উৎপন্ন দুগ্ধ প্রাথমিক পর্যায়ে কোলোষ্ট্রাম আমিষ ও ল্যাক্টোজ সমৃদ্ধ শালদুধ শাবকদেহে রোগ প্রতিরোধক। যা শাবকের রোগাক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমায় ও পুষ্টি বৃদ্ধি ঘটায়।
কাঁচা দুধের পুষ্টির পরিমাণ
প্রচুর পরিমাণে সম্পৃক্ত স্নেহ পদার্থ, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি।
দুধে পুষ্টি মূল্য
দুধে রয়েছে পানি (গ্রাম) ৮৭.৭, খাদ্যশক্তি (কিলো ক্যালরি) ৬৪, আমিষ (গ্রাম) ৩.৩, এ্যাশ (গ্রাম) ০.৭, ফ্যাট (গ্রাম) ৩.৬, কোলেস্টেরল (মিলিগ্রাম) ১১, পটাশিয়াম (মিলিগ্রাম) ১৪৪, ভিটামিন-এ (আই ইউ) ১৪০।
আল কুরআনে ব্রেস্ট ফিডিং
আল কুরআনের সূরা বাকারার ২৩৩ নং আয়াতে মা তার শিশুকে দু বছর পর্যন্ত দুধ পান করাবেন। তবে এর বেশি নয়। ইরশাদ হচ্ছে
وَٱلۡوَ ٰلِدَ ٰتُ یُرۡضِعۡنَ أَوۡلَـٰدَهُنَّ حَوۡلَیۡنِ كَامِلَیۡنِ
অর্থ: মাতৃগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবেন।
অধুনা যুগের মাতৃগণ ব্রেস্ট ফিটিং রাখতে ব্রেস্ট ফিডিং না করিয়ে সন্তানদেরকে রোগ প্রতিরোধক আদর্শ খাদ্য থেকে বঞ্চিত করেন। একদিকে যেমন সন্তানের হক নষ্ট করেন অন্যদিকে ব্রেস্ট ফিটিং এর নামে ব্রেস্ট ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানব শিশুর জন্য প্রথম ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করাতে এবং দুই বছর বা তার অধিক বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের সাথে অন্যান্য খাবার খাওয়াতে সুপারিস করে।
আল কুরআনে দুধ উৎপাদন-প্রক্রিয়া
আল কুরআনে সূরা নাহলের ৬৬ নং আয়াতে দুধ উৎপাদন তথা এর প্রস্তুত প্রণালীর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সূরা মুহাম্মদের ১৫ নং আয়াতে বেহেশতে যে কয়েক ধরনের পানীয় পান করানো হবে তন্মধ্যে একটি হলো দুধ । যার স্বাদ কখনো বিনষ্ট হবে না।
সূরা নাহলের ৫৬ নং আয়াতে দুধ উৎপাদন
وَإِنَّ لَكُمۡ فِی ٱلۡأَنۡعَـٰمِ لَعِبۡرَةࣰۖ نُّسۡقِیكُم مِّمَّا فِی بُطُونِهِۦ مِنۢ بَیۡنِ فَرۡثࣲ وَدَمࣲ لَّبَنًا خَالِصࣰا سَاۤىِٕغࣰا لِّلشَّـٰرِبِینَ
অর্থ: অবশ্যই চতুষ্পদ জন্তুতে রয়েছে তোমাদের জন্য উপদেশ। আমি তোমাদেরকে পান করাই চতুষ্পদ জন্তুর পেটের গোবর ও রক্ত হতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত খাঁটি সুস্বাদু দুধ। (সূরা নাহল: ৬৬)
দুধ যেসব উপাদানে তৈরি, সেসব উপাদান নিঃসৃত হয় “মামারী গ্ল্যান্ড” নামক দেহস্থিত একটি রসস্রাবী গ্রন্থি থেকে।
শরীরের সাধারণ পুষ্টির জন্য যে বস্তুটির প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় খাদ্য থেকে। খাদ্যবস্তু প্রথমে পরিপাকযন্ত্রে রাসায়নিক রূপান্তর সাধিত হয়ে তার সারবস্তু অন্ত্রে প্রবিষ্ট হয়ে আবার রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরিত বস্তুটি একটি উপযুক্ত সময়ে অন্ত্রের আবরণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসে দেহের সরবরাহযন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়।
রূপান্তরিত এই রাসায়নিক বস্তুটির এই যাত্রা দু’ভাবে কার্যকর হয়: এক, ‘লিমফেটিক ভেসেল’ বা ‘রসবাহী নালী’ দ্বারা এবং দুই, পরোক্ষভাবে ‘পোর্টাল সার্কুলেশন’ বা ‘মুখবাহী নালী’ দ্বারা। এভাবেই সেই রূপান্তরিত রাসায়নিক বস্তুটি লিভারে এসে আবার পরিবর্তিত হয়।
“মামারী গ্ল্যান্ড” পরিপুষ্টি পায় খাদ্যের সেই সারবস্তু থেকে যে সারবস্তু উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও রূপান্তরের মাধ্যমে রক্তধারার সহায়তায় “মামারী গ্ল্যান্ডে” পৌছায়। সুতরাং যা কিছুই খাদ্যবস্তু থেকে পাওয়া যায়, রক্ত এবং একমাত্র বক্তই সেসব কিছুর সংগ্রাহক এবং নিয়ামক হিসাবে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।
এভাবে এই রক্তই দেহের অন্যান্য যন্ত্রের মত- “মামারী গ্ল্যান্ডের”ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সাধন করে। আর এই প্রক্রিয়ায় রক্ত ও অস্ত্রের রাসায়নিক বস্তু সম্মিলিতভাবে “মামারী গ্ল্যান্ডে” তৈরি করে থাকে দুগ্ধ উৎপাদনের উপাদান।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক যে প্রক্রিয়াটি দেহযন্ত্রের সবকিছুকে সক্রিয় করে রাখে, সেই প্রক্রিয়ার আর একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে অন্ত্রের যাবতীয় বস্তুকে বিভিন্ন রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে একটি সারবস্তুতে পরিণত করা এবং সেই সারবস্তুকে অন্ত্রের আবরণের মধ্য দিয়ে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে আসা-যা সহজেই রক্তধারার সাথে মিশে যেতে পারে।
দেহের পরিপুষ্টি সাধনের ব্যাপারে এসব তথ্য, আধুনিক রসায়নশাস্ত্র এবং শারীরবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ফলেই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়েছে।
রক্তের দ্বারা সারবস্তু সরবরাহের এই প্রক্রিয়াটি উদ্ঘাটন করেছেন বিজ্ঞানী হারভে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার হাজার বছর পর।
অথচ আল কুরআন সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগে দুগ্ধ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে সূরা নাহলের ৬৬ নং আয়াতে স্পষ্ট তো উল্লেখ করা হয়েছে।
দুধ উৎপাদন প্রক্রিয়া, দুধের পুষ্টি, দুধের উপকারিতা ইত্যাদির বর্ণনা আল কুরআনে যেভাবে এসেছে, সত্যি এটি একটি বিস্ময়কর বিষয়। আমরা কুরআন না বুঝার কারণে শুধু তেলাওয়াত করি পুণ্যের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি সাধনে আল কুরআনের যে ভূমিকা, এটি আজ গবেষণার বিষয়বস্তু হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং সাবেক ডিন, থিওলজী অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।