
|| আব্দুল হামিদ সরকার ||
আমি যেদিন থাকবো না,
হয়তো সেদিনও বাতাবি লেবুর গাছের শাখায়
ছোট্ট টুনটুনি পাখি নিত্য দিনের মতো
গান শোনাতে আসবে আমায়।
আসবে জানালা দিয়ে মৃদু আলো আর রাঙা প্রজাপতি,
ঠোঁটে তৃণলতা গুজে ফুরৎ করে বসবে
আমার কাব্যর্চচার ছোট্ট কুটিরে।
আমার সাহিত্য পদকের দিকে দৃষ্টি মেলে হয়তো বলবে
কই গেলে — স্বপ্নচাষি, কলমযোদ্ধা
আর শব্দ তরঙ্গের মাঝি?
উসখুস নয়নে আমাকে না পেয়ে
নিমিষেই হবে লাপাত্তা।
আমি যেদিন থাকবো না,
হয়তো পড়ে থাকবে আমার পাদুকা দু’টি ঘরের কোণে।
আলমিরায় সাজানো আমার বই, কলম আর কাগজ,
প্রিয়জনেরা চোখের অশ্রু ফেলে
স্মৃতি সাঁতরাবে কিছুক্ষণ,
বুকফাটা কন্ঠে আমাকে করবে স্মরণ।
আমি তখন অদৃশ্যমান, নিরুত্তর, পড়পাড়ের বাসিন্দা।
আকাশের তারাগুলোও জ্বলবে,
আবির রঙে বলাকাও উড়বে,
শুধু দৃষ্টিবঞ্চিত আমি, পড়বে না মোর চোখের পলক,
আর দেখবো না প্রকৃতির বর্ণিল সাজ।
আমি যেদিন থাকবো না,
কৃষাণের মাচানে দুলবে লাউ আর বাড়ন্ত ডগাগুলো
বাতাসের সাথে করবে মিতালি,
সরষে ফুলেও বসবে মৌমাছি
রোজ বিকেলে যাদের সনে ছিলো আমার দস্তি।
দুর্বাঘাসে মুঠো রোদের ঝিলিক হয়তো খুঁজবে আমায়,
কদম্ব আর শিউলি ফুল খুঁজবে
আমার কাব্যিক মুখখানা।
আমার ছবিগুলোর সনে ভিড়ভিরিয়ে
কেউবা বলবে কথা,
বলবে– ছবিটি কি জীবন্ত, আহা সে তো ছিলো বেশ।
নিরহঙ্কার, সাদামন, আর শত্রু মিত্রদের কাছে টানার
কি যাদুমাখা চম্বুক ছিলো তার কাছে।
আমার জীবদ্দশায় পুষ্পবৃষ্টি অঢেল না পেলেও
তারাও আসবে আমায় খুঁজতে।
করোতোয়া, আত্রাই, মধুমতী আর ইছামতী
নদীর উর্মিমালা উছলে পড়বে আমার আঙিনায়।
বলবে আহা– তার কলমের সনে ছিলো
আমাদের আত্মিক বন্ধন।
আমাদের আকুতির কথা তুলে ধরতো কলমের আঁচড়ে।
আমি যেদিন থাকবো না,
সেদিনও পুষ্পিত হবে কেয়া, গন্ধরাজ
আর দোলনচাঁপার কলি।
ভোরের সমীরণে নাচবে দোয়েল,
রাতের দ্বিপ্রহরে চলবে ঝিঁঝিপোকার ডাক,
ব্যস্ত সড়কে চলবে গাড়ির হুইসিল,
মাকড়সা জাল বুনবে জানালার কার্ণিসে।
কোন কিছুই থাকবে না নীরব
শুধু আমার অস্তিত্ব থাকবে না পৃথিবীর তরে।
আমার প্রিয় রঙ লাল ও সবুজ
পসরা সাজিয়ে খুঁজবে আমায়।
বাদামী ও কফি রঙের চাদর সোয়েটার
শোভা পাবে আমার শয়নকক্ষে,
আমার স্নেহধন্য সন্তানেরা বিলাপ করবে দীর্ঘক্ষণ।
আমি যেদিন থাকবো না,
আমার কর্মস্থল কলেজ ক্যাম্পাসে
শোক ব্যনার হবে উড্ডীন,
আমার তাসবীহ জায়নামাজ পড়ে থাকবে শিয়রে।
আমার কলম সারথিরা লিখবে শোকবার্তা,
লিখবে, ওপাড়ে ভালো থেকো হে কবি বন্ধু
ফেইসবুকে লিখবে আরো যে কতো কি?
তারপর দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, আর তিন কার্যদিবসের পরে
বেমালুম ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি হবে শুরু।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমার অস্তিত্বের কফিনে
শেষ পেরেকটি বসিয়ে দিবে সবাই।
আমার নামের পূর্বে বিশেষণ হবে মরহুম,
কিন্তু ক’দিন পূর্বেই হয়তো আমাকে ছাড়া পরিবার,
সমাজ, সভ্যতা ছিলো প্রায় অচল।
আজ আমার অনুপস্থিতিতে—-
শূন্যস্থানে বসবে হয়তো অন্য কেউ।
আমি যেদিন থাকবো না,
থাকবে স্রোতসিনি নদী ফুল ফলময় বৃক্ষ,
থাকবে সাগরের জোয়ারভাটা।
মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালি সুর
আর কাশেম মালার প্রেমগীত।
আমার সূর্যদীঘল বাড়ি, দোচালা টীনের ঘর
আর আম্রমুকুল থাকবে পড়ে।
আমার পিতামাতার কবরের পাশ্বেই হয়তো হবো শায়িত
সাহিত্য পুরস্কার ও সন্মাননা গ্যালারীর কোণে
আমার ছবিটি থাকবে পড়ে, যুগ যুগান্তরে
শতাব্দী থেকে শতাব্দীর তরে।
আমার মৃত্যুদিবসে কেউ কেউ ছবির
ফ্রেমটা করবে স্মরণ।
আমি যেদিন থাকবো না, তোমাদের তরে,
স্মরণে রাখবে কি মোরে প্রতিটি ভোরে?
লেখক: বিশিষ্ট কবি ও ঔপন্যাসিক এবং সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বেলকুচি বহুমুখী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ। রচনাকাল: ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।