|| প্রফেসর ড. আ ব ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, ইবি, কুষ্টিয়া ||
বর্তমানে দেশের সরকারি বেসরকারি মিলে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা সোয়া শত। এর মধ্যে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় তাও চার ডজন হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান নিম্নমুখী ধাবিত হচ্ছে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কয়েকটি ভৌগোলিক কারণের মধ্যে একটি হলো রাজনীতি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি থাকবে কিনা এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দেশের সচেতন সুধিমন্ডলীর দুই এক জন মাঝেমধ্যে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন।
সর্বশেষ রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে রাজনীতি চালু হওয়া বিষয়ে দেশের শতকরা কতজন অভিমত ব্যক্ত করেছেন সেটা দেশের জনগণ পত্র-পত্রিকায় ফেসবুকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
এতেই বুঝা যায়, দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে রাজনীতি কতটুকু গুরুত্ব বহন করে।
আমি রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে আমার অভিমত ব্যক্ত করছি না। আমি শুধু দেশের সচেতন নাগরিকদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানের ৪৫ বছরের আমার জীবনের ঘটে যাওয়া রাজনীতির কারণে শুধু ক্ষতির দু একটি দিক তুলে ধরছি।
১. আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮১-৮২ সেশনের ছাত্র। আমার স্নাতকোত্তর রেজাল্ট হয় ১৯৮৯ তে। এ অবস্থা আশির দশকে প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগেই অভিন্ন চিত্র ছিল।
২. আমি এফ রহমান হলের ছাত্র ছিলাম। এ হল কে বা কারা কেন পুড়িয়ে দিয়েছিল? আমি ছাড়া আমার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। হলের অধিকাংশ ছাত্রেরও প্রায় একই অবস্থা হয়েছিল।
৩. রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ দশকে অন্তত এক তৃতীয়াংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্ধারিত বন্ধ ছিল। যে কারণে অন্যদের সাথে আমাকেও পাঁচ বছর অতিরিক্ত ঘানি টানতে হয়েছে।
৪. রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অনেক মায়ের কোল খালি হয়। এর সংখ্যা কারো জানা আছে কিনা জানি না।
শিক্ষকতার ৩৩ বছরে রাজনীতি না করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গায় প্রাধিকার অনুযায়ী ১০০% নিশ্চিত একমাত্র আমারই প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। সময় হলে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা যাবে।
আশির দশকের আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, সবার জানা বিষয়গুলো আমি আর স্মরণ করে দিতে চাই না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বন্ধ করতেও বলি না।
তবে বিকল্প বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য দেশের সুশীল সমাজের কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে একটি প্রস্তাব রাখছি।
সেটি হলো একটি “আবাসিক সরকার ও রাজনীতি বিজ্ঞান/রাষ্ট্র ও সরকার বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হবে-
প্রেসিডেন্ট মন্ত্রী মিনিস্টার এমপিসহ দেশের প্রশাসনিক পদপূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ছাড়া রাজনৈতিক ঐসব পদের জন্য কেউ বিবেচিত হবেন না। এতে প্রশাসনিক পদধারীদের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও পূরণ হবে।
যে বিষয়গুলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা হলো-
১. আল কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার বিষয়ক কুরআনের সকল কোর্স।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ক সকল কোর্স।
৩. আমাদের পার্শ্বদেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই রাজনীতি নেই। অথচ বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক দেশ এটি। তাদের দেশে রাজনীতিবিদগণ কোথায় গিয়ে কিভাবে রাজনীতি শিখেন এবং তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো কেন প্র্যাকটিস করেন না। সে বিষয়গুলো কোর্সের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
৪. সে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির যত ধরনের সুযোগ সুবিধা সব থাকবে। মিছিল মিটিং ধর্মঘট তথা রাজনীতিতে যতগুলো বিষয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্র্যাকটিস হয় সবগুলো কোর্সের অন্তর্ভুক্ত থাকবে আর দেশের বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতিমুক্ত থাকবে।
৫. শিক্ষার্থী ভর্তি বিষয়ে জেলা কোটা অনুসরণ করতে হবে। একটি জেলাতে যতগুলো আসন/প্রশাসনিক পদ থাকবে, ঠিক ততজন ছাত্র-ছাত্রী প্রতি জেলা থেকে ভর্তি করা।
৬. বিশ্ব রাজনীতিতে সফলতার সকল উত্তম বিষয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৭. বিশ্বসেরা রাজনীতিবিদদের জীবন ও বর্ণাঢ্য ইতিবাচক কর্ম কোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৮. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় এমন সব কোর্স।
আমার মনে হয় এ ধরনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হলে আমরা যে সুবিধাগুলো পাব তা হলো-
১. সকল বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি মুক্ত হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বরেংকিংয়ে স্থান পাবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর অনির্ধারিত বন্ধ হবে না।
৪. উচ্চশিক্ষিত রাজনীতি বিষয়ক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান পাব।
৫. রাজনীতিবিদগণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জড়াবেন না।
৬. দেশ দলীয় রাজনীতি মুক্ত হবে।
৭. রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করবে।
৮. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাবে না।
৯. কারো মায়ের বুক খালি হবে না।
১০. জীবন থেকে ঝরে যাবে না যৌবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।
১১. শিক্ষার্থীগণ স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হবে।
১২. শিক্ষার্থীগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।
১৩. চাকরি ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য সৃষ্টি হবে না।
১৪. দেশ মেধাবী ও যোগ্য নাগরিক পাবে।
১৫. গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে দেশকে আর বেগ পেতে হবে না।
আসুন আমরা দেশকে ভালবাসি। দেশকে বিশ্বের দরবারে সর্বোচ্চ আসনে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর হই।
লেখক: জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং সাবেক ডিন, থিওলজী অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।