-মো. ওমর ফারুক |
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘(হে রাসুল!) পড়ুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক্ব, আয়াত: ১)। শিক্ষা হলো একটি উৎকৃষ্টমানের জাতি গঠনের মৌলিক উপাদান। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে: ” Educatoin is the backbone of a nation ” অর্থাৎ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড যেমন কোন প্রাণীকে শক্তভাবে দাড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে, তেমনি শিক্ষার আলো একটি জাতিকে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখে। একটি শিক্ষিত জাতিই পারে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিতে এবং পারে একটি নতুন সভ্যতার জন্ম দিতে। তাইতো ভুবন-বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন, “Give me an educated mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation.”
অর্থাৎ আমাকে তোমরা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেব।
শিক্ষা সবার জন্যই অপরিহার্য। উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। তবে কথা হলো, শিক্ষা শুধু একটি জাতিকে ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথের সন্ধান দিতে পারে, কিন্তু একটি আদর্শবান জাতি উপহার দিতে পারে না, পারে না নৈতিক চরিত্রবান মানুষ গড়তে। কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ থেকে সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা বিদূরিত হয় না, গঠিতও হয় না একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। যদি তার মাঝে না থাকে সুশিক্ষার আলো। তাই, পরিপূর্ণ আলোকিত মানুষ, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, জঙ্গিমুক্ত শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র ও নৈতিক আদর্শবান জাতি গড়তে প্রয়োজন কেবল শিক্ষাই নয়, সুশিক্ষার। এজন্য সুশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা সর্বস্তরে ব্যপকভাবে আলোচনা, অর্জন এবং এ অনুযায়ী সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্ববহ বলে আমরা মনে করি।
শিক্ষা কি? বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ঊফঁপধঃরড়হ এসেছে ল্যাটিন শব্দ ঊফঁপধৎব বা ঊফঁপধঃঁস থেকে। যার অর্থ বিকশিত করা।
কুরআন-হাদিস এবং আরবি ভাষায় শিক্ষার জন্যে পাঁচটি শব্দের ব্যবহার সুবিদিত। সেগুলো হলো : ১. তারবিয়াহ (শিক্ষা, প্রতিপালন, পরিচর্যা) ২. তা‘লিম (শিক্ষা, উপদেশ, নির্দেশ) ৩. তাদিব (শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার শিক্ষাদান) ৪. তাদরিব (প্রশিক্ষণ, চর্চা, অনুশীলন) ৫. তাদরিস (পাঠদান, শিক্ষাদান, পড়ানো)
সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন।
সক্রেটিসের ভাষায়- ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’, এরিস্টটল বলেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।’, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘শিক্ষা হলো তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’
সাধারণভাবে বলা যায়, মানুষের আচরণের কাঙ্খিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরির্বতনই হলো শিক্ষা।
সুশিক্ষা কি? সুশিক্ষা হলো অর্জিত জ্ঞানকে যথাযথ আদর্শায়ন করা। অর্থাৎ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অর্জিত শিক্ষার প্রয়োগগত আদর্শ দিকই হলো- সুশিক্ষা। যে শিক্ষার আলোয় হৃদয়লোককে করে উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত ও জ্ঞান-সমৃদ্ধ। সে শিক্ষা সমাজ ও জাতি গঠনে সু-পরিকল্পিতভাবে সকল মঙ্গলময় চেতনায় উদ্ভাসিত জগৎ সৃষ্টি করে। আর এটাই হলো শিক্ষার প্রয়োগগত দিক। আর প্রয়োগগত দিকগুলোর ভিত্তিতেই শিক্ষা, ‘সুশিক্ষা’ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
কারণ, শিক্ষা আর সুশিক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা মান ও ধ্যান-ধারণার। পুষ্পকুঞ্জের মৌসমৃদ্ধ রাশি রাশি একই ফুল থেকে মৌমাছি শোষণ করে মধু, আর ভ্রমর গ্রহণ করে বিষ। কি আযব ব্যাপার! আশ্চর্য হওয়ার কিছইু নাই, এটিই মহান আল্লাহ তা‘আলার অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে যদি আমরা ফুল মনে করি, তবে ভ্রমর ও মৌমাছি হলো এর দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতা। ফুল থেকে বিষ কিংবা মধু গ্রহণ করার দৃশ্যত পার্থক্যই আমাদেরকে শিক্ষা আর সুশিক্ষার ভিন্নতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়।
সুশিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব : আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন নাযিল শুরু করেন সুরা আলাক্বের শিক্ষা বিষয়ক প্রথম পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে । মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” (সুরা আলাক্ব, আয়াত: ৪-৫)। তাই বলা যায়, কুরআনের শিক্ষাই হলো প্রকৃত শিক্ষা তথা সুশিক্ষা। সুশিক্ষা আলোর সমতুল্য। সূর্য যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে, উপযুক্ত শিক্ষাও তেমনি মানুষের মনোজগতের অন্ধকার বিদূরিত করে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে আমরণ। সূর্যের যেমন কোন বিকল্প নেই, সুশিক্ষা ছাড়া অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার দূর করার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কোন ব্যক্তি সামনে এসে দাঁড়ালে ত্রাসে হৃদয় প্রকম্পিত হয়, তার হুংকারে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, কিন্তু সুশিক্ষায় আলোকিত কোন ব্যক্তির সামনে আপনাতেই বিমুগ্ধ শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়ে যায়।
সভ্যতার এই উৎকর্ষণ মানবজাতির বিশুদ্ধ ভাবনার উন্মুক্ত ফসল। জীবন যাত্রার ধাপ পরিক্রমায় এই উন্নতি বা অগ্রগতি; জীবন জিজ্ঞাসার কাছে অত্যাবশ্যকীয়, যা যুগ যুগ ধরে সমাজ-সভ্যতাকে প্রভাবিত করছে। মান, সময় ও নিরাপত্তা এই তিনটি শব্দই জীবনচক্রকে আবর্তিত করছে বিধায়, পরিশোধিত চিন্তার অধিকারী মানুষকে এই ‘চক্রাকার আর্বতন, ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। জীবনচক্রের এই অন্তহীন পথে, সুশিক্ষাই-মানব মুক্তির একমাত্র পাথেয়; যা দেশ, কাল, জাতি ও মহাকালের স্বাক্ষী।
সুশিক্ষা গ্রহণের সুফল : সুশিক্ষার সুফলের আগে আমরা দৃষ্টি দেব, সুশিক্ষার অভাবে আমাদের দেশের কয়েকটি চিত্রের দিকে। দেশ-বিদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সনদগ্রহণকারীরা কি কেবল উচ্চ শিক্ষিত, না সুশিক্ষিত হচ্ছে? সুশিক্ষিতই যদি হবে, তাহলে তাদের মাধ্যমে দেশ ও জাতি আলোকিত হয়ে উদ্ভাসিত হতো বিশ্ব-দরবারে। আমি সবার কথা বলছি না, যারা উচ্চ শিক্ষার লেবাস পড়ে কুশিক্ষিত হয়ে দেশ ও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, ধর্মের নামে অধর্মীয় গর্হিত কার করছে, তাদের কথা। মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষক কখনো তার মেয়ে সমতুল্য ছাত্রীর সাথে অনৈতিক কাজে জড়াতে পারে না, পারে না কমলমতি ছেলেদের ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিপনার মতো অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করতে। একজন দায়িত্বশীল আমলা কখনো পারে না, ঘুষ-দূর্নীতির মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেই সমস্ত ছাত্র, যাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা, তাদের হাতে প্রতিবেশী মেয়েশিশু, বোন সমতুল্য সহপাঠী ও প্রেমের নামে বান্ধবীরা ধর্ষণের শিকার হতে পারে না। পারে না তারা বই-খাতা-কলম ফেলে দিয়ে দেশীয় ও বৈদেশীক আগ্নেয় অস্ত্র হাতে নিয়ে কা-জ্ঞানহীন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটাতেও । দুঃখের বিষয় যে, এগুলিই ঘটছে। প্রমাণস্বরূপ সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সিলেটের খাদিজাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য জনসম্মুখে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বদরুলের চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করা জাহেলি যুগের বর্বরতাকেউ হার মানায়। আবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ধর্মের নামে গুলশানের হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ার ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানে নির্মম, নির্দয় পাষাণের ন্যায় হত্যাযজ্ঞের মত জঙ্গি কর্মকাণ্ড ঘটায়। এসব কর্মকাণ্ডকারীরা শিক্ষিত তো দুরের কথা তারা আর মানুষই থাকে না, পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যায়। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘তারা আসলে চতুষ্পদ জন্তু, তার চেয়েও নিকৃষ্ট।’ (সূরা আ‘রাফ:১৭৯)
তাই শিক্ষার সর্বস্তরে যদি উজ্জল আদর্শে উদ্ভাসিত সুশিক্ষা থাকতো, তাহলে সমাজ থেকে এ অপরাধগুলো বিদূরিত হয়ে সূর্য্যদীপ্ত আলোতে উজ্জল হয়ে উঠতো পৃথিবী। একজন মানুষ যদি কেবল শিক্ষা নয়, সুশিক্ষা গ্রহণ করে; তাহলে তার মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের সাথে সাথে বিকশিত হবে তার মানসিক শক্তির। গড়ে উঠবে একজন নৈতিক চরিত্রবান, আদর্শিক, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। মৌলিক অধিকারের প্রতি সচেতন থেকে মানবাধিকারের প্রতি হবে শ্রদ্ধাশীল। পিতা-মাতা, গুণীজন ও বয়োজেষ্ঠ্যগণের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হবে। নিজস্ব মূল্যবোধের পাশাপাশি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি জন্মাবে গভীর প্রেম এবং অকৃত্তিম ভালবাসা। শান্তি, সমৃদ্ধি, সমঝোতা, সহিষ্ণুতায় হবে অনন্য। জীব-প্রকৃতির প্রতি হবে দয়াশীল। অপরাপর সভ্যতার প্রতিও হবে শ্রদ্ধাশীল।
তাই প্রতীয়মান হয় যে, সুশিক্ষা অর্জনের ফলে, মানুষের মনকে সর্বপ্রকার কলুষ থেকে মুক্ত করবে, মানসিক রোগের জীবাণু বিনষ্ট করে দেবে এবং মনিবতার সকল দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা ও লুণ্ঠন বন্ধ করে দেবে; সেই সঙ্গে তা মানবীয় প্রয়োজন পূরণার্থে প্রাকৃতিক উপায়-উপকরণ পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করার, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্যে প্রয়োজনীয় খোরাক-পোশাক ও বাসস্থানের ইনসাফপূর্ণ বন্টনের ব্যবস্থা করার, সকল প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঝড়-তুফান ও বন্যা-প্লাবনের মাত্রা ক্রমাগত হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং সকল শ্রেণির মানুষের জন্যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ-স্ফূর্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করার যোগ্য হবে।
শেষ কথা হলো- শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে শিক্ষিত ভেবে উন্নত শিরে দাঁড়াবার কোনো উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সভ্য জাতি গঠনে স্বীয় মেধার সঠিক ব্যবহারে শিক্ষাকে সুশিক্ষায় পরিণত করার প্রয়াসে উদ্বুদ্ধ না হবে, ততক্ষণ তো জাতির জন্য মহা অমাবস্যা অপেক্ষমান।
তাই আসুন, দীপ্ত কণ্ঠে শপথ গ্রহণ করি, কেবল শিক্ষা নয় সুশিক্ষা অর্জন করি। আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুশিক্ষার অর্জনের মাধ্যমে মানবাত্মাকে পরিশোধিত করি। আলোকবর্তিকা হয়ে দূর করি অমানিষার সকল ঘোর অন্ধকার। আলোক-উজ্জ্বল করে গড়ে তুলি পরিবার, সমাজ ও দেশ। এতে আলোকময় হোক সারা জগত।
লেখক: এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।