বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৫

মৈত্রীর ৫৪ বছর এবং মস্কোর–দিল্লি সফর

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—ভারতের লোকসভার অধিবেশন চলছে। টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী (মিসেস গান্ধী) প্রস্তুতি নিচ্ছেন লোকসভায় বক্তব্য রাখার। করতালি ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য তিনি লোকসভার ট্রেজারি বেঞ্চের প্রধানমন্ত্রীর আসনে দাঁড়ালেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চারদিকে তাকিয়ে স্পিকারের দিকে তাকিয়ে তিনি বক্তব্য শুরু করলেন। বক্তব্য শুরু করতেই লোকসভার সব সদস্য টেবিল চাপড়াতে শুরু করেন। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে লোকসভার স্পিকারও টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধীকে।

দৃঢ় কণ্ঠে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন—“ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করার।” তুমুল করতালির মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর ওই ঘোষণার ৬ ডিসেম্বর ২০২৫-এ পূর্ণ হলো ৫৪ বছর। স্বীকৃতির ৫৪ বছর, মৈত্রীর বন্ধনের ৫৪ বছর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘প্রিয়দর্শিনী’ ইন্দিরা গান্ধীর সেই ঐতিহাসিক অবদান কোনোদিন ভোলার নয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এক অনন্য প্রাপ্তি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গৌরব। মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতার স্বাদ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবদান নিঃসন্দেহে স্মরণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার দামাল ছেলেরা দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে এই বাংলাদেশ। মিত্রবাহিনী আকাশপথে, নৌপথে ও স্থলপথে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে—অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী কার্যত নিজের জীবনকে বাংলাদেশের দুর্ভোগপীড়িত মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের অবজ্ঞা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের নৈশভোজের খাবার ফিরিয়ে দেওয়া এবং এক টুকরো কেক প্যাকেট করে বাংলাদেশের অভুক্ত ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানানো—সবই ছিল তাঁর মানবিকতার উদাহরণ।

মৈত্রীর এই বন্ধনে ভারত–বাংলাদেশকে আবদ্ধ রেখেছে অনেক ঘটনার সেতুবন্ধন। মৈত্রী দিবসের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন—“জনগণকে প্রধান অংশীদার করে ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়তে চায় ভারত।” বিজয়ের এই মাসে আমরা স্মরণ করি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের, স্মরণ করি ভারতীয় সেনাদের, যারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সীমান্ত কখনো বিভেদ তৈরি করতে পারে না—গুরুদাসী মাসির আত্মত্যাগ এটি প্রমাণ করে, যা বারবার স্মরণীয়।

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। সম্প্রতি রাশিয়া–ভারত অংশীদারি সম্মেলন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। পাকিস্তান–আফগানিস্তানের যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ৪ জন নিহত হওয়ার খবর আমাদের হতাশ করেছে। অপরদিকে রাশিয়া–ইউক্রেন অস্ত্রবিরতির কাছাকাছি পৌঁছানো খবরটি বিশ্ব রাজনীতির জন্য তুলনামূলক ইতিবাচক।

গত সপ্তাহজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মস্কোর–দিল্লি সফর। মাত্র ২৭ ঘণ্টার সফর হলেও তা ছিল ব্যস্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। সব প্রটোকল ভেঙে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বাগত জানান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে।

পুতিন সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখযোগ্য। তাঁর পূর্ণ নাম ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন প্রাক্তন কেজিবি গুপ্তচর কর্মকর্তা, পরে রাশিয়ার রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন। তিনি আইন পেশায়ও যুক্ত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে রুশ অর্থোডক্স গির্জার সদস্য পুতিন সাবেক বিমানবালা লিদমিলা শ্ব্রেবনেভাকে বিয়ে করেছিলেন; তাঁদের সংসারে দুই কন্যা—মারিয়া ভোরোন্তসোভা ও ক্যাটেরিনা তিখনোভা।

পুতিনের এই সফরে ভারত–রাশিয়ার মধ্যে ১৬টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্যসুরক্ষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম বিষয়ক নানা চুক্তি এতে অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করে পুতিন ভারতকে “নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের” প্রস্তাব দিয়েছেন। দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে জ্বালানি, কৃষি ও শ্রম সংক্রান্ত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।

অর্থনৈতিক সম্পর্কে কিছু বৈষম্য থাকলেও চীন এখনো রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০২৪ সালে রাশিয়া চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ৪% ছিল।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্রধারী সাবমেরিন ও ডেস্ট্রয়ার পাঠিয়ে আমেরিকার মোকাবিলা করে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়।

ভারতের অতিথি হয়ে আসা পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছয়টি বিশেষ উপহার দেন—

আসাম ব্ল্যাক টি, কাশ্মীরি জাফরান, হাতে বানানো রূপার ঘোড়া, নকশাদার চা সেট, ধর্মগ্রন্থ গীতার রুশ সংস্করণ, আগ্রার মার্বেল পাথরের দাবার সেট

৩৪০ কক্ষবিশিষ্ট প্রাসাদে তাঁকে রাখা হয়। যদিও চুক্তির তালিকা প্রাসাদের কক্ষের সংখ্যার মতো দীর্ঘ নয়, তবু যে চুক্তিগুলো হয়েছে, তা দুই দেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারিত্বের জন্য যথেষ্ট।

রাশিয়া–ভারত অর্থনৈতিক সহযোগিতা কর্মসূচি ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও সাপ্লাই চেইন সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। জ্বালানি প্রসঙ্গে রাশিয়া ভারতকে “নিরবচ্ছিন্ন” সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

দিল্লির বিমানবন্দরে মোদির আলিঙ্গনে পুতিনকে যেভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে—তা রাশিয়ার জনগণ প্রশংসা করেছে। দুই নেতা বক্তব্যে একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এই সফরের মূল কেন্দ্র ছিল বাণিজ্য; তবে এর ভূ-রাজনৈতিক বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত–রাশিয়ার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া নিঃসন্দেহে মার্কিন স্বার্থের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। মার্কিন প্রভাব এশিয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও কমতে পারে। অন্যদিকে চীন–রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা নতুন এক শক্তিশালী আঞ্চলিক জোটের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *