সোমবার, নভেম্বর ৩

ভারত–আফগান সম্পর্ক ও পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতা

গাজায় শান্তি ফিরুক। সন্তানহারা অনেক মায়ের অশ্রুবিসর্জনের মাধ্যমে গাজায় শান্তি ফিরে আসুক—এটি আমাদের প্রত্যাশা। অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক শিশু অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে। বিশ্ব দেখেছে মৃত্যুর হাহাকার কাকে বলে। টন টন বোমা পড়েছে গাজায়। অবশেষে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে। নতুন দিনের আশায় ঘরে ফিরতে শুরু করেছে ঘরছাড়া মানুষ।

নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা মানুষের জীবনে এখনও হতাশা কাজ করছে। শান্তি চুক্তি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেটি নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। বিশ্ব পররাষ্ট্রনীতি ও ভূ-রাজনীতি পরিবর্তনশীল। মার্কিন শুল্কনীতির মাধ্যমে চীনের ওপর প্রবলভাবে চাপ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সত্যটা হলো—এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়া অনেকটা হাস্যকর। যাই হোক, চীন রাশিয়া ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছে।

পররাষ্ট্রনীতিতে ‘শেষ কথা’ বলে কোনো কথা নেই। দুবাইতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব অমিত মিশ্রি আফগান সরকার প্রতিনিধির সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছিলেন, পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণদীর জয়সওয়াল বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। এই দুজন ব্যক্তি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন দৃঢ়তার সঙ্গে।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে ভূমিকম্প পরবর্তীতে যে সহযোগিতা ভারত সরকার করেছে, সেটি আফগান সরকার মনে রেখেছে। রাশিয়া কিন্তু অনেক আগে থেকেই আফগান সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সীমিত আকারে তুলে নেওয়ার পর আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে এসেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর স্বাগত জানিয়েছেন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্তাকিকে।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এটি প্রথম সফর। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর তাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়েছেন। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া ও চীন যখন এক পথে হাঁটছে, ভারত তখন তাদের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শুল্কনীতি বিশ্বকে বিভক্ত করেছে।

যাই হোক না কেন, আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর ছিল বেশ দীর্ঘ—টানা ছয় দিনের। তিনি গত ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সীমান্ত সংঘাত চরমে। সম্প্রতি বিমান হামলায় আটজন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন ছিলেন ক্রিকেটার। কোনো হত্যাকাণ্ডই আমাদের কাম্য নয়। প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের মৃত্যুর ঘটনায় আফগান ক্রিকেট বোর্ড পাকিস্তান সফর থেকে সরে এসেছে।

পরিস্থিতি যেটাই হোক না কেন, আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে স্বীকার করে নিয়েছেন—ভারত ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে যে সহযোগিতা করেছে, সেটি তারা প্রশংসা করে। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ভারত আগ্রহী।

আফগানিস্তানও চায় দ্রুত উন্নয়নের দিকে যেতে। ভৌগোলিকভাবে আফগানিস্তান অবস্থান করছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায়। ইতিমধ্যে ভারতীয় নয়টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ভারতীয় কয়েকজন ব্যক্তির প্রতিও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা। অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে ইরান থেকে কাঁচামাল, বিশেষ করে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য ক্রয়কে।

মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে—মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে চায় ভারত। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাশিয়া স্বীকৃতি দিলেও ভারত সময় নিয়েছে। তবে সাহায্যের হাত প্রসারিত রেখেছে ভারত।

ভারত ঘোষণা করেছে, তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছে। এর অংশ হিসেবে কাবুলে ভারতের টেকনিক্যাল মিশনকে এখন থেকে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাসে উন্নীত করা হবে। এই ঘোষণা দেওয়ার সময় জয়শঙ্করের পাশে ছিলেন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।

আফগান-পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার কথাটিও ভাবতে হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল, যা পাকিস্তানের জন্য অনেক সহায়ক হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু আফগান-পাকিস্তানের বৈরিতার মধ্যে কাতার ও সৌদি আরবও এখন সমঝোতার কথা বলছে। কাতারের দোহায় দুই দেশকে নিয়ে যুদ্ধবিরতির চিন্তাভাবনা চলছে।

বিশ্ব পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তিত হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, পরিবর্তন তত বেশি হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেই সফলতা আসবে। ভারত-আফগান আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতি আরও পরিবর্তিত হবে—এটিই প্রত্যাশিত।

ভারত-আফগান সম্পর্ক যদি ইতিবাচক অগ্রগতি লাভ করে, তাহলে ভূ-রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরকে নিয়ে যেমন শুভ আলোচনা আছে, তেমনি সমালোচনাও কম হয়নি। সমালোচকদের মোকাবিলায় ভারত সরকার বেশ জোরেশোরে অবস্থান নিয়েছে।

সব মিলিয়ে আফগানিস্তান চায় ভারত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সহযোগিতা করুক, তালেবান সরকারকে পুনর্গঠনে পাশে দাঁড়াক। ভারতও চায় আফগানিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বৈশ্বিক পরিসরে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার একটি উপায় হিসেবেও ভারত এই সম্পর্ককে দেখছে।

ইতিমধ্যে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সৌদি আরবের সঙ্গে পারস্পরিক রক্ষার চুক্তি থাকলেও সৌদি আরব এখন সমঝোতার কথা বলছে। ভারত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।

ভারত চাইছে তার পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে, যাতে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করা যায়। মার্কিন বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশের মাধ্যমে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায় ভারত।

আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষ না হতেই শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গেছেন—যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনীতি এক নতুন পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি অনেকেই বুঝতে পারছেন। মুক্ত বিশ্বে এখন সব কিছুই ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে।

সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও ভারত এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নয়টি প্রতিষ্ঠান ও আটজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে মস্কো প্রতিদিন ১৬ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল তেল ভারতে রপ্তানি করছে—যা দেশটির মোট তেল আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে মোদি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেও নিজের অর্থনীতি চাঙা রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মস্কো প্ল্যান বাস্তবায়নে রাশিয়া তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত যদি আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেশনস’-এর প্রভাব আরও গভীর হবে।

বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন ঘটছে। নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করে দিতে ট্রাম্পের আহ্বান, নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় তার ক্ষোভ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন অস্থির এক পরিবর্তনের মুখোমুখি।

দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টার আলোচনার পর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে সেটি কতটা বাস্তবায়িত হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। মার্কিন অর্থনীতি চাপে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকেও কিছু সেনা ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে—কারণ বলা হচ্ছে ‘অর্থনৈতিক সংকট’।

সব মিলিয়ে মার্কিন অর্থনীতির ওপর অতিনির্ভরতা এখন বোকামির সামিল। ভারত চায় আফগানিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও জোরালো হোক। পররাষ্ট্র সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র—সবার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের দৃঢ় কূটনৈতিক নেতৃত্বেই এই সফর সফল হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতের চলমান সম্পর্কও ইতিবাচক। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির ফলে যে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে, তা হয়তো কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

ভারতীয় অর্থনীতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো—তীব্র সংকটেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এখন প্রশ্ন—এই বিক্ষোভের ভাষা কি তিনি বুঝতে পারছেন?

শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ভালো। চীনের বিলাসী প্রকল্পে যুক্ত হয়ে শ্রীলঙ্কা পথ হারিয়েছিল, তবে ভারতের সহযোগিতায় তারা অর্থনীতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে—যা কঠিন হলেও সম্ভব হয়েছে।

ভূ-রাজনীতি পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর, ভারত-চীন-রাশিয়ার একসঙ্গে পথ চলা—সবকিছুই নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক দিগন্তের ইঙ্গিত বহন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *