
|| মোঃ লিটন হোসেন | বিশেষ প্রতিনিধি (নওগাঁ) ||
নওগাঁর বদলগাছীতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হলো মিঠাপুর আদর্শ কলেজ।
মিঠাপুর আদর্শ কলেজ যার একাডেমিক স্বীকৃতি সনদ নম্বর EIIN নম্বর: ১২৩১৪১।
প্রতিদিন ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা কোলাহলে মূখরিত হয়ে উঠত নওগাঁর বদলগাছী মিঠাপুর আদর্শ কলেজ প্রাঙ্গণ। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে হাতে হাতে বই খাতা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচল যেন নিভৃত পল্লীগ্রামের শোভা মান বর্ধিত করত। এলাকাবাসীর স্বপ্ন প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে কলেজটি। এ কলেজ থেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়, কিন্তু দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় মুখ থুবরে পড়ে এগিয়ে চলার গতি। অবশেষে চালু হলো ছাত্র-ছাত্রীদের কোলাহলে মূখরিত কলেজটি, যা একসময় বেহালদশায় পড়ে ছিল।
বিগত সময় তথ্য সংগ্রহকালে দেখা যায়, টিনের চাল উড়ে গেছে। দরজা জানালা ভাঙ্গাচোড়া। আর শ্রেণিকক্ষের ভেতর ময়লা-আবর্জনা ও মলমূত্র। ২০০৮ সালের ফলাফলের দিক থেকে উপজেলায় সবার সেরা ছিল কলেজটি। অথচ ৮ বছর পর ২০১৬ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই কলেজের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এ কলেজের পাঠদান বন্ধ হলেও কলেজটিতে আবারও শিক্ষার পরিবেশ ফিরাতে অধ্যক্ষসহ কয়েকজন শিক্ষক কলেজে আসা যাওয়া করেন।
আড়াই বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজে রয়েছে একতলা দুটি ভবন। একটি সেমি পাকা (টিনের চাল), অন্যটি পাকা। কলেজের মূল ভবনে একটি কক্ষে ভাঙ্গাচোড়া বেঞ্চ-চেয়ার জরো করে রাখা হয়েছে। কলেজের দক্ষিণ দিকের ভবনটির কয়েকটি টিনের চালা উড়ে গেছে। মড়িচা ধরে ঝড় বৃষ্টিতে খুলে খুলে পড়ছে। দরজা জানালা বা ছাদ না থাকায় শ্রেণিকক্ষগুলো মল-মূত্র আর ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। কলেজে লেখাপড়া করার মত কোনো পরিবেশ নেই। দুপুর সাড়ে ১২টার পর অধ্যক্ষসহ সবাই কলেজ থেকে চলে যান।
কলেজ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে মিঠাপুর আখতার হামিদ সিদ্দিকী নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে কলেজটি পড়ানোর অনুমতি পায়। ২০০৩ সালে কলেজটি একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। আখতার হামিদ সিদ্দিকী নান্নু সে সময় নওগাঁ-৩ (বদলগাছী-মহাদেবপুর) আসনের বিএনপি’র দলীয় সংসদ ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। আখতার হামিদ সিদ্দিকী জোট সরকারের আমলে তার নামে হওয়া কলেজটি এমপিভুক্ত করতে পারেননি। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নামকরণের কারণে কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষার প্রদীপ নিভে যায়। অবকাঠামোগত সকল উন্নয়ন থেকেও বঞ্চিত হয়।
পরে আখতার হামিদ সিদ্দিকী কলেজের নাম পরিবর্তন করে মিঠাপুর আদর্শ কলেজ নামকরণ করা হয়। এরপরেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় স্বেচ্ছাশ্রমে র্দীঘদিন কলেজটি পরিচালনার পর অভাব অনটনে শিক্ষক কর্মচারীরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা বলেন, শুরুর দিকে কলেজটিতে প্রচুর শিক্ষার্থী ছিল। কলেজের অবকাঠামো নষ্ট ও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে থাকে। এখন আর এ কলেজে পড়াশুনা হয় না।
অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল্লাহ বলেন, কলেজটিতে শিক্ষক-কর্মচারীসহ ২৮ জন কর্মরত রয়েছেন। কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে তারা মানবেতর জীবর-যাপন করছেন। বাধ্য হয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ বেছে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি ও কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত কলেজে আসা যাওয়া করছেন।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, কলেজটি ২০০৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের দিক থেকে বদলগাছী উপজেলায় সেরা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে পাঁচজন শিক্ষার্থী এ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়, কিন্তু কেউ পাস করেনি। ২০১৭ সালে দুজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তারা পাস করেছেন। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে মানবিক বিভাগে ১৪ জন, বিজ্ঞান বিভাগে ১০ জন ও বাণিজ্য বিভাগে ৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এসব শিক্ষার্থী তাদের সুবিধামত অন্য কলেজে পড়াশুনা করছে।
শিক্ষক সেলিম হোসেন বলেন, তারা কলেজ থেকে কোনো টাকা পয়সা পান না। কলেজটি এমপিওভুক্ত হলে বেতন-ভাতা পাবেন, এই আশায় এখানে পড়ে আছি। প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসা করতে প্রায় ১০০ টাকা খরচ হয়। এভাবে কতদিন নিজের পকেটের টাকা খরচ করব।
গত ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর বর্তমানে কলেজটি আবারও পুনরায় চালু করা হয়েছে। বর্তমানে কলেজটিতে আবারও নতুন করে আসবাবপত্র স্থাপন করা হয়েছে। পুনুরায় চালু হয়েছে শ্রেণির কার্যক্রম।
কলেজটির মূলত এইচএসসি কেন্দ্রীক কলেজ। কলেজটি বিগত সালের এইচএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থী ও পাসের হার তুলে ধরা হলোঃ-
২০০৩ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৮ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ১১ জন।
২০০৫ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩০ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ১৮ জন। ২০০৬ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫৬ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ২২ জন। ২০০৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৬১ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ২৬ জন। ২০০৮ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৯২ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ৭২ জন সেই বছরে কলেজটি ফলাফলের দিক থেকে উপজেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে। ২০০৯ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩২ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ১৯ জন। ২০১০ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪১ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ২২ জন। এভাবে কলেজটি চলতে থাকে।
কলেজটির বর্তমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন।
শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ২৩-২৪ জন।
এলাকাবাসী বলেন, মিঠাপুর কলেজের সমসাময়িক সময়ে উপজেলার কোলা আদর্শ কলেজ, বদলগাছী মহিলা ডিগ্রী কলেজ, গোবরচাঁপা হাট কলেজ, বদলগাছী কারিগরি কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে এবং কলেজগুলো সফলভাবে চলছে। গ্রামের অসহায় হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এসব কলেজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। এ এলাকার শিক্ষার্থীরা এসএসসির পর অর্থের অভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্যই এলাকাবাসী মিঠাপুর আদর্শ কলেজটি এমপিওভুক্ত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
এ বিষয়ে কলেজটির অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল্লাহ আরও বলেন, কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানান জটিলতা বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত সরকার আমলে কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়। কলেজটির বর্তমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন নিয়ে আবারও শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতা ও সাড়া পেলে আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো।
