
কৃষকের স্বপ্ন ভেসে গেছে কুড়িগ্রামের দুধকুমার–ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে
|| কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ||
উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামের মানুষের জীবন যেন প্রতিবছরই বন্যার সঙ্গে যুদ্ধের আরেক নাম। এবছরও ব্যতিক্রম নয়। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া টানা অতিবৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে জেলার ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী এলাকা — বিশেষ করে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়।
এখন বন্যার পানি ধীরে ধীরে নেমে গেলেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র। হাজার হাজার একর আমন ধানের ক্ষেত পানির নিচে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও গাছ মরে গেছে, কোথাও ধান গাছের গোড়া পচে গেছে। কৃষকদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ—সারা বছরের পরিশ্রম যেন মুহূর্তেই ভেসে গেলো স্রোতের জলে।
নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, বেরুবাড়ি কালীগঞ্জ, নুনিখাওয়া, নারায়ণ পুর, কচাকাটা; ভুরুঙ্গামারীর পাথরডুবি, বলদিয়া, শিলখোয়া; এবং কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ধানের ক্ষতি হয়েছে ভয়াবহভাবে।
বামন ডাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল হামিদ (৫২) জানালেন, “তিন বিঘা জমিতে আমন রোপন করেছিলাম। দেড় মাস বয়সের সময়েই সব পানি তলায় গেলো। এখন পানি নেমে গাছ দেখা গেলেও শিকড় পচে গেছে—এ ফসল আর উঠবে না।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলায় প্রায় ৮,৫০০ হেক্টর আমন জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৩,০০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট বলে ধরা হচ্ছে।
বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে নদীভাঙন। ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী গ্রামগুলোতে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি।
ভুরুঙ্গামারীর বলদিয়া ইউনিয়নের কৃষক মজনু মিয়া বলেন, “আগে নদী ছিলো ঘর থেকে এক কিলোমিটার দূরে, এখন উঠোনেই পানি ঘুরছে। গত সপ্তাহে আমার এক বিঘা জমি নদী খেয়ে ফেলেছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নদীভাঙন রোধে জিওব্যাগ ফেলার কাজ সীমিত পরিসরে চলছে, তবে বন্যার পর মাটি নরম হয়ে পড়ায় ভাঙন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বন্যায় শুধু ফসল নয়, ক্ষতি হয়েছে ঘরবাড়ি, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু ও মাছের ঘেরেরও। অনেকে বীজতলা হারিয়েছেন, ফলে আগাম মৌসুমে রোপণ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
নাগেশ্বরীর কচাকাটা ইউনিয়নের কৃষক আমির আলী বলেন, “বন্যার পানি ওঠার আগে ধান বাঁচাতে গিয়ে নিজের শেষ সম্বল একটি গরু বিক্রি করেছি। এখন গরু ও গেলো জমিও গেলো, হাতে কিছুই নেই।”
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি ও বিনামূল্যে বীজ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবছরই এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয় কুড়িগ্রামের তীরবর্তী মানুষদের। নদীভাঙন, বন্যা, ও পুনর্বাসনের চক্র যেন তাদের জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে। তবুও তারা বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন—মাটির প্রতি মমতা, পরিশ্রম ও আশা নিয়েই।
স্থানীয় সমাজকর্মী ওমর ফারুক (মাষ্টার) বলেন, “এই মানুষগুলো দুর্যোগে ভেঙে পড়ে না। সরকার ও এনজিওদের সমন্বিত উদ্যোগে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও কৃষি সহায়তা পেলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”
কুড়িগ্রামের উত্তর তীরের এই জনপদ আজ বন্যার পর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন আশার অপেক্ষায়।
বন্যার পানি নেমে গেলেও ক্ষতির স্রোত এখনো থামেনি—
যে মাটিতে স্বপ্ন বোনা হয়েছিল, সেখানে আজ শোকের ছায়া।
তবু সেই মাটির মানুষরা জানে—
জীবন থামে না, নদী যেমন বয়ে চলে, তেমনি তাদের লড়াইও চলবে।