বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯

জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় আসছে নতুন সংশোধনী

|| নিউজ ডেস্ক ||

জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই সনদ-২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়ায় নতুন কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সনদের অঙ্গীকারনামা অংশে কিছু বিতর্কিত প্রস্তাব বাদ দেওয়া হচ্ছে এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি মূল সনদের অংশ হিসেবে থাকছে না। কমিশন মনে করছে, এসব বিষয়ে স্পষ্ট ঐকমত্য না থাকায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত না করাই সঠিক হবে।

সনদের প্রাথমিক খসড়ায় উল্লেখ ছিল, সংবিধান বা আইনে যা-ই থাকুক, জুলাই সনদই প্রাধান্য পাবে। কিন্তু বিএনপি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি ছিল, সংবিধান ও আইনকে পাশ কাটিয়ে কোনো দলিলকে সর্বোচ্চ আসনে বসানো সাংবিধানিক ভারসাম্যের জন্য হুমকি হতে পারে। বিএনপির আপত্তি আমলে নিয়ে কমিশন এখন বলছে, যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধন দরকার হবে, সেসব ক্ষেত্রে জুলাই সনদের সুপারিশ প্রাধান্য পাবে, তবে তা হবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

খসড়ায় আরও একটি প্রস্তাব ছিল, সনদের ব্যাখ্যার একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের হাতে। এই প্রস্তাবও বিএনপিসহ আটটি দল প্রত্যাখ্যান করে। তারা জানায়, এটি আদালতের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব বিষয় আদালতের এখতিয়ারে পড়ে, সেগুলো নিয়ে আলাদা করে সনদে কিছু বলা হবে না। অর্থাৎ, সনদের ব্যাখ্যার ক্ষমতা নিয়ে আর কোনো অঙ্গীকার খসড়ায় রাখা হচ্ছে না।

প্রাথমিক খসড়ায় একটি প্রস্তাব ছিল, সনদের বৈধতা বা কার্যকারিতা নিয়ে আদালতে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। বিএনপি এই ধারাটিকেও স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানায়, আদালতে যাওয়ার অধিকার নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, সেটি রুদ্ধ করা যাবে না। আপত্তির প্রেক্ষিতে এখন ভাবা হচ্ছে, সংশোধিত খসড়ায় বলা হতে পারে, সনদে স্বাক্ষর করা কোনো দল আদালতের দ্বারস্থ হবে না। তবে নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কিছু বলা হবে না।

এছাড়া, সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি। খসড়ায় গণভোট, সংসদ, গণপরিষদ, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশসহ ছয়টি বিকল্প পদ্ধতির কথা বলা হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপিসহ কয়েকটি দল গণভোটের পক্ষে মত দেয়। অন্যদিকে, বিএনপিসহ কয়েকটি দল জানায়, সংসদ ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি তারা মানবে না। এ অবস্থায় কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সনদের খসড়ায় আর বাস্তবায়নের পদ্ধতি রাখা হবে না। পরিবর্তে, বিকল্প প্রক্রিয়াগুলো সুপারিশ আকারে সরকারের কাছে পাঠানো হবে। সরকারই চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, কোন পদ্ধতিতে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে।

১৬ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায়। এতে আটটি অঙ্গীকারনামা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোট ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল সাড়া দিয়েছে এবং মতামত দিয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অঙ্গীকারে ভাষাগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, চূড়ান্ত সনদটি দুই খণ্ডে প্রকাশ করার চিন্তা করা হচ্ছে। প্রথম খণ্ডে থাকবে যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে এবং যেগুলো প্রশাসনিক আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে সাংবিধানিক সংশোধন প্রয়োজন এমন প্রস্তাব এবং যেগুলো নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে অথবা যেসব প্রস্তাব নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

সর্বমোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৭৩টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। বাকি ১১টি প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি। এর মধ্যে ৯টি প্রস্তাবে বিএনপি সরাসরি আপত্তি জানিয়েছে।

সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পদ্ধতি ও খসড়া পর্যালোচনায় গত সোমবার সংসদ ভবনের কমিশন কার্যালয়ে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের দেয়া মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত বিশ্লেষণ করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও বৈঠকে অংশ নেন।

কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, প্রতিটি দলের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো বিষয়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। কমিশন চায়, সনদ ও তার সুপারিশ যেন আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সংশোধিত খসড়া হাতে পেলে, আগামী মঙ্গলবারের মধ্যেই সনদের চূড়ান্ত খসড়া এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *