বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯

‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ গঠনে বাংলার রুমির আদর্শ অনুসরণের আহ্বান

|| নিজস্ব প্রতিবেদক ||

‘বাংলার রুমি’ খ্যাত শাহসুফি সৈয়দ আহমদুল হকের চতুর্দশ ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সেমিনারে বৈষম্যহীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে বাংলার রুমির আদর্শ অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রামের জামালখানে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানানো হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “পারসিয়ান রেনেসাঁর ধারক মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির চেতনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন সৈয়দ আহমদুল হক। ১৯৯২ সালে তিনি আল্লামা রুমি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভ্রাতৃত্বই ছিল রুমির চেতনার মূল ভাবনা।

“রুমির ভাবনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ভালোবাসাই ছিল মূল ভিত্তি। রুমির দার্শনিক চেতনাকে রাষ্ট্রীয় চর্চার কেন্দ্রে আমরা আনতে পারিনি। পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ এবং এর পথ ধরে আসা লিবারেলিজম ও এরপরের নিওলিবারেলিজম থেকে আস ধ্যানধারণা থেকেই আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে।”

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “শিক্ষা ও পলিটিক্যাল ইকোনমিতে আমরা এখনো পাশ্চাত্যের ধারণাকে অনুসরণ করে চলছি। কিন্তু সমাজে বৈষম্য বিদ্যমান। এই বৈষম্য রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন কতটা সম্ভব? বৈষম্য ও ঘৃণা, যা বাড়ছে তা কমাতে না পারলে সমাজে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। আশা করি রুমি সোসাইটি সমাজে এই ভাবনা গঠনে ভূমিকা রাখবে।”

অনুষ্ঠানের সভাপতি সাবেক মুখ্যসচিব ও আল্লামা রুমি সোসাইটির সভাপতি ড. মো. আবদুল করিম বলেন, “সৈয়দ আহমদুল হক বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের চিন্তা করেছিলেন। বর্তমানে যে বৈষম্যহীন সমাজের রূপরেখা আমরা চিন্তা করছি এমন সময় সৈয়দ আহমদুল হকের ভাবনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

“তিনি সুফিবাদের চর্চা ও প্রসারে কাজ করেছেন। মসনবি শরীফের চর্চাকে জনপ্রিয় করেছেন। সরকারি আমলা হলেও তিনি পাকিস্তানের দুই অংশে বৈষম্য নিরসনে কাজ করেছেন। তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যে কোনো ধর্মের যথাযথ চর্চা হলে সমাজে বিদ্বেষ থাকতে পারে না। সকল ধর্মের মূল বাণী এক। সৈয়দ আহমদুল হক সাম্য শান্তি মৈত্রীর বাণী শুনিয়েছেন। আজকে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে তার মতাদর্শ অনুসরণ করা খুব জরুরি।”

‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে বাংলার রুমি সৈয়দ আহমদুল হক’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সোশাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।

সৈয়দ আহমদুল হক রচিত ‘ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলার রুমির সুযোগ্য শাহেবজাদী সৈয়দা জারাঙ্গেজ নিলুফার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ মো. সিরাজউদ্দোল্লাহ।

সেমিনারের সমাপনী বক্তা পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান ও আল্লামা রুমি সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধে যে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে তা দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের ক্ষুধা, শিক্ষা ও বাসস্থানের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হত। পশ্চিমা সভ্যতা মানবতার কথা বলে, অথচ ফিলিস্তিনে হাজার হাজার মানুষকে আজ হত্যা করা হচ্ছে।

“মানব সভতা ততদিন পূর্ণতা পাবে না, যতদিন সবাইকে আমরা মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে পারব না। আল্লামা রুমি বলেছেন, আউলিয়াদের সাথে মহব্বত সান্নিধ্যে মানুষের হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায়। শিক্ষার সাথে দিক্ষা লাগে। জীবনে প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সৈয়দ আহমদুল হক একজন পরিপূর্ণ মানুষ ও একজন আদর্শ বাবা ছিলেন। তার সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তারা ধন্য হয়েছেন।”

অনুষ্ঠানে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর এম এম নূরুল আবসার বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কোনো বিকল্প নেই। এখন সারা বিশ্বে হানাহানি। তাই এটা আরো বেশি প্রয়োজন এই সময়ে। উনার জীবন থেকে এই শিক্ষা নিতে পারি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে।”

আল্লামা রুমি সোসাইটি বাংলাদেশের উপদেষ্টা ও সৈয়দ আহমদুল হকের বড় শাহেবজাদা শাহসুফি সৈয়দ মাহমুদুল হক বলেন, “আব্বা বলতেন, স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হলে সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। উনি যা বলতেন তা বিশ্বাস করতেন এবং চর্চা করতেন। ১৯৮০ সালে চাকরি থেকে অবসরের পর পুরোটা সময় তিনি সুফিবাদ সাধনায় ব্যয় করেন।

“১৯৬২ সালে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক বৈষম্য নিরসন করা না গেলে বিভক্তি আসন্ন। স্বাধীন বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন।”

আলোচনায় অংশ নিয়ে ইউএসটিসির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, “সৈয়দ আহমদুল হক ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব নাগরিক। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। সবাইকে মানবতা অনুসরণ করতে বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজেই সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন বলেন, “একটি সমাজে যখন সকল ধর্ম ও মতের মানুষ নিজস্ব মতামত নিয়ে বসবাস করবে সেটাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। সেরকম একটি সমাজ ব্যবস্থায় সকলের ন্যায্য অধিকার ও সমমর্যাদা থাকবে। তেমন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন সৈয়দ আহমদুল হক। উনার স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজ যেখানে সব মানুষ শান্তিতে একসাথে বসবাস করবে।”

পাথরঘাটা ক্যাথিড্রাল চার্চ প্রধান ফাদার রিগান ডি’ কস্তা বলেন, “এদেশে সুফিরা মানুষের অন্তর স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। আমরা পাশাপাশি থাকি কিন্তু পাশের জনকে চিনতে পারি না। সবাইকে জানতে হবে। এক সাথে এগিয়ে যেতে হবে।”

দ্য সাউথ এশিয়া ফোরাম ফর ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অর রিলিফের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের বোর্ড মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার শুভ্র দেব কর বলেন, “সৈয়দ আহমদুল হক ধর্ম ও মতের ঊর্ধ্বে মানবপ্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষে মানুষে তিনি কোনো ভেদাভেদ করতেন না। ঐক্য স্থাপনই ছিল উনার লক্ষ্য। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে চ্যালেঞ্জ আছে। আজকের বাস্তবতায় সমাজ যখন নানা কারণে বিভক্ত তখন তার এই শিক্ষা অনুসরণ বেশি জরুরি।”

আল্লামা রুমি সোসাইটি বাংলাদেশ এবং চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

১৯১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ আহমদুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত এবং ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারে পড়ালেখা করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৪৪ সালে। ১৯৮০ সালে অবসর গ্রহণের সময় তিনি ছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক।

তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে আছে- আ শর্ট হিস্ট্রি অব চিটাগং, চট্টগ্রামের শিল্প ও বাণিজ্য, প্রবন্ধ বিচিত্রা, দ্যা স্পিরিট অব মসনভী শরীফ, মসনভী শরীফের কাহিনী ও মর্মবাণী, মুরলীর বিলাপ, দিওয়ানে শামস তাবরিযী, ফারসি গযল সংকলন, মসনবী শরীফের পয়গাম ও তফসির: বাণী ও ভাষ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলাদেশের সুফি সাহিত্য, এবং দ্যা মেইন থিম অব দি আল্লামা রুমি সোসাইটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *