
|| আব্দুর রহিম ||
পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা না থাকার কারণে অসৎ ধনকুবেরদের ছত্রছায়ায় বিভিন্নভাবে দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এ সকল অসৎ ব্যক্তিদের দেশ বিদেশের নামকরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি আছে, কিন্তু সৎ আল্লাহভীরু হওয়ার ডিগ্রি নেই। যার ফলে দেখা যায়, তারা মুসলিম হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলাম কী বলেছে সেটা যেমন জানেনা; ঠিক তেমনিভাবে ব্যবসা ক্ষেত্রে ইসলামি বিধিনিষেধ মানার চেষ্টাও করে না। তাই দেখা যায়, অধিক মুনাফা অর্জনের চিন্তা, কালোবাজারি, খাদ্য গুদামজাত করা, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ইত্যাদি অসৎ কাজ তারা নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে।
পাইলটিং সিস্টেমে প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে একটি করে মাদ্রাসায় ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ চালু করা বর্তমান সময়ে ইসলাম প্রিয় বাংলাদেশী মুসলিমদের প্রাণের দাবি।
রসূল (স.) বলেছেন, ” নীচের হাতের চাইতে উপরের হাত উত্তম”। আর আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো ” উপরের হাতের চাইতে নীচের হাত মনে হয় উত্তম”। আমরা খালি নিতে শিখেছি এবং আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে তাই শিখাই। আমরা শিখাই ইমামতি। আর এদেশের সকল বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইসলাম বিরোধীদের হাতে এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অনুষদ জেনারেল শিক্ষার্থীদের দখলে। মনে হয় এরকম চুক্তি হয়েছে যে তারা ইনকাম করে দিবে। আর আমরা বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবো আর খাবো! আমরা কী সেই সাহাবীর কথা ভুলে গেছি, যাকে আনসার সাহাবীরা সহযোগিতা করতে চাইলে সে বলেছিলো, ❝ আমাকে শুধু বাজারটা দেখিয়ে দাও❞।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আবদুর রহমান ইবনু ’আওফ (রাঃ) মদিনায় আসলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এবং সা’দ ইবনু রাবী’ আল আনসারী (রাঃ)-এর মধ্যে ভ্রাতৃ বন্ধন গড়ে দিলেন। এ আনসারীর দু’জন স্ত্রী ছিল। সা’দ (রাঃ) ’আবদুর রহমান (রাঃ)-কে নিবেদন করলেন, আপনি আমার স্ত্রী এবং সম্পদের অর্ধেক নিন। তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ্ আপনার স্ত্রী ও সম্পদে বারাকাত দিন। আপনি আমাকে বাজার দেখিয়ে দিন। এরপর তিনি বাজারে গিয়ে পনির ও মাখনের ব্যবসা করে লাভবান হলেন। কিছুদিন পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শরীরে হলুদ রং-এর দাগ দেখতে পেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, হে ’আবদুর রহমান। তোমার কী হয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন, আমি এক আনসারী মেয়েকে বিয়ে করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত মাহর দিয়েছ। তিনি উত্তরে বললেন, খেজুরের আঁটি পরিমাণ স্বর্ণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওয়ালীমার ব্যবস্থা কর, একটি বকরী দিয়ে হলেও। (আ. প্র.: ৪৬৯৯, ই.ফা.বা: ৪৭০২)
মাদ্রাসায় ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ চালু করার কথা বললে অনেক মাথা মোটা আলেম প্রচলিত অর্থনীতি ও ব্যবসা শিক্ষা বিভাগের কথা চিন্তা করে ফতোয়া দেওয়া শুরু করে দিবেন। যে মাদ্রাসা ধ্বংসের জন্য এক শ্রেণির লোক মাদ্রাসায় সুদ চালু করার পায়তারা করছে।এদের থেকে আপনারা সাবধান থাকবেন। আরে ভাই ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ মানে সুদ না। ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ হলো ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা ও কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিভিন্ন ব্যবসার নীতি ও মার্কেটিং পলিসি তৈরি করা। যা বর্তমানে ইসলাম বিরোধীদের হাতে রয়েছে। তাদের অর্থ থাকার কারণে তারা সেই টাকা ইসলামের বিপক্ষে ব্যয় করে। আর আমাদের বাণিজ্য বিভাগ চালু করার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। অর্থনৈতিক সমাজ আলেম সমাজের হাতে নিয়ে আশা। মানুষকে একটা অর্থনৈতিক মুক্তি দান করা।
ইসলাম ধর্ম মানুষকে সৎ পথে অর্থোপার্জনে উৎসাহিত করেছে এবং আল্লাহ তায়ালা সৎ ও হালাল উপার্জন করা ফরজ করেছেন। আর নিষেধ করেছে অসৎ পথে রোজগার। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, জুমুআর দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে শিগগিরই ধাবিত হও, ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে! অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়, আর আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে থাক, যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পার।’ (সুরা: জুমুআ: ৯-১০)
সৎ ব্যবসায়ীরা নবিদের সাথে থাকবেন। কারণ রসূল( স.) বলেছেন :
সত্যবাদী ব্যবসায়ীর জন্য নবী (সা.) দিয়েছেন মন-ভালোকরা সুসংবাদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে।’ (তিরমিজি: ১২০৯)
যেমন: ধরুন আপনি ইয়াহুদিদের পণ্য বর্জন করবেন। তাহলে আপনাকে বাজারে আগে তার বিপরীতে আরেকটা পাণ্য তৈরি করে ছাড়তে হবে। এখন যদি আপনার ব্যবসায়িক নীতিমালা ও অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে তো আপনার ব্যবসায় লস হবে। আমরা ব্যবসা মানে বুঝি দুই নম্বর পণ্য এক নম্বর বলে চালিয়ে মুসলিমদেরকে ঠকানো।
অর্থনৈতিক মূল চালিকাশক্তি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। আর সেই শক্তি থেকে বঞ্চিত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। যদি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বড় বড় ব্যবসায়ী হতেন, তাহলে দেশ ও ইসলামের জন্য অনেক উপকার হতো। আমরা শুধু আলেম ও আমলা তৈরি করছি। কিন্তু অর্থ হলো রাষ্ট্রের রক্ত স্বরূপ। মানুষ যেমন শরীরে রক্ত ছাড়া বাঁচতে পারে না। ঠিক তেমনিভাবে অর্থ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ চালু নেই। বিজ্ঞান বিভাগেরও একই অবস্থা। সব মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগ নেই। অথচ মুসলিমরা যতদিন কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চা করেছিলেন ততদিন সম্পূর্ণ পৃথিবী শাসন করেছিলেন। আর এখন বিজ্ঞানের চর্চা রয়েছে অমুসলিম দেশগুলোতে। তাই আজ ক্ষমতা তাদের হাতে।
ব্যবসা শিক্ষা ও বিজ্ঞান পড়া হারাম ফতোয়া দিয়ে এর দায়িত্ব অমুসলিমদের হাতে তুলে দিয়েছি। এমন কোনো মুসলিম বিজ্ঞানীর (ইবনে সিনা, জাবের ইবনে হাইয়ান, ইবনে হায়সাম ও আল-খারেজমী) কথা আমরা শুনতে পাই না। আমরা শুনতে পাই না “বায়তুল হিকমাহ”,” দারুল হিকমাহ” এর মতো কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের কথা। তাই সকল মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ খোলাও প্রয়োজন। আর সেটা ইসলামের স্বার্থেই খোলা প্রয়োজন। এর সাথে সাথে দক্ষ শিক্ষকও নিয়োগ দিতে হবে। কারণ অমুসলিমদের টাকা-পয়সা বেশি থাকায় তারা ইসলামের বিরুদ্ধে সে সব টাকা খরচ করে।
এবার ব্যবসার কথা বলা যাক, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) নিজে একজন দক্ষ ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। যার প্রমাণ তিনি হযরত খাদিজা (র.) এর ব্যবসার দায়িত্ব পালনকালে দেখিয়েছিলেন। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেছিলেন। বহু সাহাবী (রা.) তাঁদের জীবদ্দশায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। অনেক তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীরা (রহ.) ব্যবসা করেছেন। “মুখতাসারে কুদুরী “গ্রন্থের লেখক ইমাম কুদুরী (রহ.) হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসা করতেন। আমাদের ইমাম আযম আবু হানিফা( রহ.) কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (র.) একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
হাদিসের এবং ফিকহের প্রতিটি গ্রন্থে” কিতাবুল বুয়ু” ( ক্রয়-বিক্রয়) বা ব্যবসার অধ্যায় রয়েছে। যদি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ব্যবসা শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে দেশ, ইসলাম এবং মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা অনেক উন্নতি লাভ করবে। আজ দেখা যাচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ী হলেন অমুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী। তাই তাদের কোম্পানিতে চাকরি করতে হলে দাড়ি কাটতে এবং অনৈসলামিক পোশাক -পরিচ্ছেদ পড়তে বাধ্য করেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ চালু করা সময়ের দাবি। এর সাথে জেনারেল ব্যবসা শিক্ষার সে সমস্ত বই -পুস্তক রয়েছে সেগুলোর সাথে ইসলামের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন বই প্রণয়ন করতে হবে। তবে আমার জানা মতে বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিং ও বীমা, ইসলামি অর্থব্যবস্থা, আধুনিক ইসলামি ব্যাংকিং ও ইসলামি ব্যবসা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলামি নীতিমালা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর অনেক বাংলা ভাষাসহ অন্যান্য ভাষায় প্রচুর বই রয়েছে।
বর্তমানে মাদ্রাসায় দুইটি বিভাগ চালু রয়েছে। এক. সাধারণ বিভাগ, দুই. বিজ্ঞান বিভাগ। এর সাথে ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ যুক্ত হলে ভালো হবে।
ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে গড়া আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত অর্থনীতি, ভেজাল ও শোষণমুক্ত বাজার ও রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হবে।সুতরাং ব্যবসা হোক জীবন, ইসলাম ও রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, সৈয়দ আব্দুল মান্নান ডি. ডি. এফ আলিম মাদরাসা, বরিশাল।
ইমেইল :hasibur0213@gmail.com