শুক্রবার, মার্চ ১৪

উচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব সৃষ্টিঃ উদরপিন্ডি বুদোর ঘাড়ে!

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়বস্তু। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমে শিক্ষিত করা হচ্ছে, কিন্তু তার ফলস্বরূপ তারা চাকরির বাজারে কার্যকরভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারছে না। এই প্রবণতা শুধুমাত্র ব্যক্তির জীবনে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান নাগরিক তৈরি করা, যারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোতে এই উদ্দেশ্য প্রায়শই পূরণ হয় না। বর্তমান পাঠক্রমে যুগোপযোগিতা, ব্যবহারিক দক্ষতা ও শিল্পপ্রত্যাশিত জ্ঞানচর্চার ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করলেও চাকরির বাজারে চাহিদার সঙ্গে তাদের যোগ্যতা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।

বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যেমন প্রযুক্তিগত দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে, তেমনিভাবে সৃজনশীলতা ও বাস্তবভিত্তিক দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এখনও পুরোনো শিক্ষাক্রম চালু আছে, যা চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশেষ করে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রাসঙ্গিক কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সুযোগ কম পায়।

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা কার্যক্রম অপ্রতুল। পাশাপাশি শিক্ষকদের মানোন্নয়ন এবং পাঠদানের আধুনিক পদ্ধতির অভাবও শিক্ষার্থীদের কার্যকর শিক্ষালাভে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সমাজে হতাশা ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। বেকারত্বের ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত শিক্ষা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত হয়।

দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনৈতিক মারপেঁচ দ্বারা প্রভাবিত। তাই শিক্ষাকে তার সঠিক পথে হাটতে দেয়া হয় না। দ্বিধাবিভক্ত জাতির বিভাজনের সুযোগের দুর্নীতি ও বৈষম্যের মাধ্যমে প্রতিরোধক হিসেবে অশুভ শক্তি কম দায়ী নয়। এছাড়া দিনের পর দিন অনুকরণপ্রিয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবিগণও শিক্ষার সঠিক দর্শন তৈরি করেননি। আবার বাস্তবায়নকারীও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন কিংবা কাজে গাফিলতি ও দুর্নীতি করে গেছেন। আগে শুনা যেত মাদরাসায় পড়ুয়ারা ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে অযোগ্যতায় সরকারি চাকুরী পায় না। অথচ তারা সাধারণ উচ্চশিক্ষিতদের মতো বেকার থাকে না। নিশাগ্রস্ত হয় না। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কাজে লেগে পড়ে। তারা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকে না। এ ক্ষেত্রে সহজে অনুমেয়, বাংলাদেশে শিক্ষার সঠিক দার্শনিক ভিত্তি নেই। এখানে সনদ সর্বস্ব চাকুরী প্রার্থী তৈরি করা হয়।

১. শিক্ষাক্রম সংস্কার: চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রম তৈরি করতে হবে।
২. প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন: শিক্ষার্থীদের আইটি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
৩. শিল্প ও শিক্ষার যোগসূত্র স্থাপন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ ও বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়।
৪. উদ্যোক্তা উন্নয়ন: শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
৫. গবেষণার গুরুত্ব: গবেষণা কার্যক্রমকে প্রণোদনা দিতে হবে এবং তা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
৬. চেতনার পরিশুদ্ধি: শিক্ষার সঠিক দর্শনে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা প্রস্তুত করতে হবে।
৭. দুর্নীতি উৎস বন্ধকরণ: নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থের তসরুপ বন্ধ করতে হবে।
৮. উদ্যোক্তার নিরাপত্তা: নতুন উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
৯. জবাবদিহিতা: শিক্ষার প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতি ঠেকাতে কঠোর হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার সঠিক দর্শন নির্ধারণ, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন, সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মুকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সঠিকভাবে তদারকি করলে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র ডিগ্রি প্রদান সনদ সর্বস্ব হবে না। সহজ কথায় সবার আগে চেতনার ত্রুটি দূর করতে হবে। তাদের জন্য এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা তাদের বাস্তব জীবনে সফল হতে সাহায্য করবে। বেকারত্ব কমাতে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে উচ্চশিক্ষার কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনা অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *