বুধবার, জানুয়ারি ১৫

ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান আমাদের কিছুকথা (শেষ কিস্তি)

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের অসম্ভব দূরদর্শীতা বলতে হবে, তারা যে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান একজন ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রের হাল ধরার দায়িত্ব দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস না হলে হাসিনা-উত্তর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হত কিনা আমরা চিন্তা করতে পারছি না। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শেষ ভরসা ছিল ভারত। জনগণের আশঙ্কাও ছিল এখানে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা এতকাল জোর জুলুমের স্টীম রোলার চালিয়েছে, যাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও ছিল, তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা জমাট হয়ে রয়েছিল জনমনে। শেখ হাসিনার পলায়নে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়, তাতে জ্বালাও পোড়াও হয়, হিন্দু আওয়ামী লীগ নেতারাও কোথাও কোথাও আক্রান্ত হন। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছুলোক সে ঘটনাগুলোকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমন বলে প্রপাগান্ডা শুরু করেন, প্রতিবাদের নামে বড় বড় হিন্দু সমাবেশের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতকে আক্রমণাত্মক ভূমিকার জন্য ডেকে আনা।
এ ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বিরাজিত একটি সৌন্দর্য়ের প্রদর্শনী হলো। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তিপূজা শিরক, অমার্জনীয় পাপ, অপরাধ। ইসলাম এসেছে শিরক ও মূর্তিপূজার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য । কিন্তু দেশবাসী পরিস্থিতির স্পর্শকাতরাতা উপলব্ধি করলেন। মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক, মসজিদের ইমাম মুসল্লি ও ইসলামী দলগুলোর সাথে জড়িত লোকেরা রাত জেগে হিন্দুদের মন্দির পাহারায় নিয়োজিত হলেন। উদ্দেশ্য, মন্দিরে গীর্জায় হামলা চালিয়ে কেউ যাতে ভারতীয় আগ্রাসনের অজুহাত খাড়া করতে না পারে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের দু একটি কথায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উস্কানী তৈরির কৌশল সম্পুর্ণ নিস্তেজ হয়ে যায়, তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। হিন্দু নেতাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে তিনি বললেন, আপনারা নিজেদেরকে সংখ্যালঘু ভাবছেন কেন। এখানে তো আইন আদালত সবার জন্য এক ও সমান। হিন্দুদের জন্য তো আলাদা আইন বা আদালত নেই। কোথাও আক্রান্ত হলে বাংলাদেশী হিসেবেই প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি, যিনি মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে ভারতে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছেন, তাকে তিনি ফোনে বললেন, আপনি বাংলাদেশে আসেন অথবা লোক পাঠান, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রকৃত অবস্থা দেখে যান। ড. মুহাম্মদ ইউনুস এ কয়টি কথায় সাম্প্রদায়িক উস্কানী, উত্তেজনা, গৃহযুদ্ধ ও ভারতীয় হস্তক্ষেপের গভীর নীল নকশা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। অবশ্য ভারত এরপরও বাংলাদেশের জনগণ থেকে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। বিনা নোটিশে উজানের বাধ খুলে দিয়ে ফেনীসহ কয়েকটি জিলা জলের আক্রমনে তলিয়ে দিয়েছে, অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে বাংলাদেশের জনগণকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে, ভারত কোনো দিনও বাংলাদেশের বন্ধু নয়। বস্তুত ড. মুহাম্মদ ইউনুস এ কয়দিনে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন বা কথাবার্তা বলেছেন, তাতে তিনি জাতির প্রাথমিক প্রত্যাশা পূরণ করবেন বলেই আশা করতে পারি।

যারা বাংলাদেশে ইসলামী সরকার বা হুকুমতের স্বপ্ন লালন করেন, তাদের উদ্দেশে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে দুটি কথা বলব। কথাগুলো আমার নয়, মরহুম আব্দুল খালেক সাহেবের। তিনি উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ইসলাম মানে সাইকেল চালানো। আপনি যতক্ষণ সাইকেলে উঠে প্যাডেল চালাতে থাকবেন ততক্ষণ সাইকেল চলতে থাকবে। প্যাডেল চালানো বন্ধ করলে, আপনাকে শুদ্ধ সাইকেল পড়ে যাবে। ইসলামের অবস্থাও তাই। যতদিন আপনি আল্লাহ ও রাসূলের পথে অবিচল গতিতে পথ চলতে থাকবেন ততদিন আপনার ইসলাম ঠিক থাকবে, পথচলা বন্ধ করলে আপনার ইসলামও ছন্দ হারিয়ে ফেলবে। আপনার দ্বারা ইসলামের প্রতিষ্ঠা বা হেফাজত কোনোটাই হবে না।

আমরা বিনোদনের জন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যাই। সমুদ্র তীরের শান্তির পরশ আর সাগরের গর্জনে মুগ্ধ হই। কবিরাও সমুদ্র সৈকতে যান, সেখানে তাদের মুগ্ধতা অন্যকিছু নিয়ে। তারা নিথর সৈকতের সাথে কথা বলেন। আল্লামা ইকবালের সাথে স্বয়ং সৈকত কথা বলেছিল। জীবন রহস্য জানতে চেয়ে বলল, আমি পড়ে আছি কতকাল এভাবে সাগর কুলে, অথচ বুঝলাম না, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা কাকে বলে। কবিকে তার জবাব দিতে হয়নি। হঠাৎ সাগর তরঙ্গের একটি ঢেউ হুঙ্কার দিল প্রচন্ড গর্জনে। বলল, “হাস্তম আগর মী রওয়াম, গর নরওয়াম নীস্তম।” আমি আছি যতক্ষণ আমি গতিমান চলছি, পথচলা থেমে গেলে আমি আর নাই।’

মরহুম আব্দুল খালেকের দ্বিতীয় কথাটি ছিল অনেকটা এরূপ। ইসলামী হুকুমত মানে দেশের রাষ্ট্রের সবকিছু ইসলামী হয়ে যাওয়া নয়। ইসলামী রাষ্ট্র মানে সেখানে ইসলামের পথে, আল্লাহ ও রাসূলের শিক্ষার উপর পথচলা সহজ হয়ে যাবে আর অন্যায় পথে চলা কঠিন হবে। আর অনৈসলামিক সমাজ ও রাষ্ট্র বলতে বুঝায়, সেখানে পাপ ও অন্যায় করা, ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করা সহজ আর ইসলামের পথে চলা কঠিন হয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন হলো, দেশে বর্তমানে যে মুক্ত পরিবেশ এসেছে তাতে আপনার ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নটা কীভাবে রচনা করবেন। (শেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *