|| ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ||
নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের চেষ্টা
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার পতনের পেছনে আমেরিকার ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে শেখ হাসিনা যে দাবি করেছেন, তা যে মিথ্যার বেসাতি তার প্রমাণ, ছাত্রদের আন্দোলনের শুরুতে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না বা তারা সরকার পতনের ডাক দেয়নি। শেখ হাসিনাই চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের মতো একটি ছোট্ট দাবিকে দমাতে গিয়ে একের পর এক ভুল করে নিজের পতন ঘটিয়েছেন। মওলানা রূমী (র) বলেছেন, আসমানের ফয়সালা যখন এসে যায়, তখন চোখ থাকতে অন্ধ, জ্ঞানী বুদ্ধিমানও আহম্মক হয়ে যায়। এ বারের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করলে বুঝা যাবে, জনগণের উপর জুলুম নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় অর্থচুরি, বিশেষ করে আয়নাঘরের পাপের বোঝাই আসমানী অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। সরকারী চাকরির ৩০% মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য, ৫% উপজাতি ২০% নারী আর ১% প্রতিবন্ধীর নামে মোট ৫৬% সরকারী চাকরি পকেটে নিয়েছিল। ছাত্রদের কথা ছিল, সরকারী চাকরির ৫৬% ভাগ কোটা ব্যবস্থার দখলে চলে গেলে বাকী মাত্র ৪৪% নিয়ে মেধাবী ছাত্ররা বঞ্চিত হবে, দেশ পরিচালনার ভার মেধাহীনদের কাঁধে গিয়ে পড়বে, দেশ পিছিয়ে যাবে আর স্বার্থ শিকারীদের জয়জয়কার হবে।
সরকারী কর্মচারীরা, এমনকি আর্মির লোকজনও দেখেলেন যে, তাদের মেধাবী সন্তানরাও বঞ্ছনার শিকার হবে। তাই ছাত্রলীগের পক্ষ হতেও শুরুতে এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো হয় বলে জানা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের অবস্থান বদলায়। তারা উল্টা পুলিশের চেয়েও বিভৎস চেহারায় আন্দোলনরত ছাত্রদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে।
কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অগ্রাধিকারের ব্যাপারে আপত্তি ছিল না; কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিদের জন্য কোটার কথা বলা হলো, তখন ছাত্ররা নিরূপায়। ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ তুলে দেয়ার কথাও বলেনি। বলেছে সংস্কারের কথা। এই দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে এক পরিপত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা কোটা ব্যবস্থা রহিত করেছিলেন; কিন্তু বিরোধীদের দলন দমনের পর যখন নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার মালিক ভাবতে লাগলেন তখন চলতি ২০২৪ সালের শুরু থেকে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের ঘোষণা দিলেন।
ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারের সাথে বসে বিষয়টি সুরাহার জন্য বারবার প্রস্তাব দিল। তারা আদালতেরও শরণাপন্ন হলো। কিন্তু নেত্রী অনড়। তিনি আলোচনার পরিবর্তে রাস্তায় লাশ ফেলার পলিসি নিলেন। কাদের সাহেব, কামাল সাহেব নেত্রীকে হাততালি দিলেন। আদালতও রায় দিল কোটা বহল থাকবে। ধীরে ধীরে আন্দোলন ঢাকার বাইরে চলে গেল। লীগের ক্যাডারদের তান্ডব, পুলিশের গুলি আর নেত্রীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আন্দোলনকে বেগবান করল।
এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা আন্দোলন থামানোর জন্য দুটি কৌশল প্রয়োগ করল। হঠাৎ রাতের অধারে গণপরিবহনের ডিপু, মেট্রো রেল, রামপুরার টিভি স্টেশন ও ইন্টারনেট কেবল স্টেশন প্রভৃতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পপর্কাতর স্থাপনায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটল। সরকার বয়ান দিল, জামায়াত শিবির বিএনপি অগ্ণি সন্ত্রাস চালিয়ে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। লক্ষ্য, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা, ছাত্রজনতার উপর জোর জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দেয়া। মনে করল, ইন্টারনেট বন্ধ করলে আন্দোলন থেমে যাবে। দলন দমনের ক্ষতচিহ্ণ মিডিয়ায় প্রকাশ পাবে না। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে গেল। জনগণ বুঝল, সরকার ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের চেষ্টা করেছে।’ (চলবে……)
লেখক: ইসলামিক স্কলার ও গবেষক এবং ফিচার সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।