|| কবি আমিন আল আসাদ ||
একজন কবিতা ও ছড়ার কর্মী হিসেবে তথা একজন সাহিত্যকর্মী হিসেবে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাব আমি তুলে ধরতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে, সূন্দর, সমৃদ্ধ, দূর্নীতি মুক্ত, পরমত সহিষ্ণু, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রেক্ষিতে নুতন সমাজ গড়তে আমার এই সব প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখতে পারেন এ প্রজন্মের মুক্তি সংগ্রামের নায়কেরা। গ্রহণও করতে পারেন, সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন অথবা দু একটি প্রস্তাবও যদি ভালো লাগে নিতে পারেন অথবা আমার প্রস্তাবগুলোকে আপনাদের নিজেদের চিন্তা চোতনার কষ্টি পাথরে যাচাই করে গ্রহণ, বর্জন, সংযোজন, পরিমার্জন করে নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিতে পারেন—–
১ [ এক ]
আমার প্রথম ও প্রধান প্রস্তাব বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, প্রত্যকটি রাজনৈতিক দলকে সংস্কার করতে হবে। সেসব দলে শিক্ষিত, নীতিবান ও সৎ লোকের সমাবেশ ঘটাতে হবে।
২ [ দুই ]
আপনাদের রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনের ১০০% সমর্থক হিসেবে বলতে চাই, যে কোনো মূল্যে দেশে পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩ [ তিন ]
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে সৎ, শিক্ষিত, ধর্মভীরু, দেশপ্রেমিক মানুষের নিয়োগ দিতে হবে।
৪ [ চার ]
দূর্নীতিবাজ অসৎ লেকগুলোকে অপসারণ করতে হবে।
৫ [ পাঁচ ]
ঠক, লোভী, বর্বর, শোষক, সিন্ডিকেটবাজ, টেন্ডারবাজ, চোর, চোট্টা, বদমাইশ, হারামী, হারামজাদা, হারামখোর, ভুমিদস্যু, ঘুষখোর লোককে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে ও আইনের আওতায় আনতে হবে। এবং ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের লোক সমাজে তৈরি না হয় সেই প্রচেষ্টা করতে হবে।
৬ [ ছয় ]
শিক্ষা ব্যাবস্থাকে আমুল পরিবর্তন করে স্বদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় শিক্ষা (যার যার ধর্ম শিক্ষা), অসাম্প্রদায়িক নীতিমালা এবং জাতীয় শুদ্ধাচারের আলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুমানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৭ [ সাঁত ]
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ইসলামের অনুসারী হিসেবে প্রত্যেক মুসলমান তার ধর্মীয় শিক্ষায় যেমন শিক্ষিত হবে, তেমনি দেশের সকল ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্মের চর্চা ও তাদের ধর্মীয় মানবিক মূল্যবোধের আলোকে নিজেকে গড়ে তুলবে।
৮ [ আট ]
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় অবাধ চর্চার সুযোগ থাকতে হবে।
৯ [ নয় ]
সংবাদপত্র ও মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে।
১০ [ দশ ]
বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, নৃগোষ্ঠী সবাই যাতে তাদের নিজ নিজ ধর্মের আদর্শ ও জীবন সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, এই নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
১১ [ এগারো ]
যে কোনো মূল্যে সকল প্রকার ধমীয় সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা দূরীভূত করতে হবে।
১২ [ বারো ]
প্রত্যেক ধর্মমতের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মত-মাজহাব আছে, চর্চার পার্থক্য ও ভিন্নমত আছে। যেমন ইসলাম ধর্মের মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ২০/২৫ ধরনের মতের, সংস্কৃতির মানুষ আছে। এই প্রভেদগুলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, দর্শনগত কিংবা ঐতিহাসিক কারণে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রত্যেকের মধ্যেই যথাযথ যুক্তি ও কারণ আছে। কারো যুক্তিই কম শক্তিশালী নয়। কিন্তু তা স্থান, কাল, পাত্র হিসেবে আপেক্ষিক ও প্রায়োগিক। একজন মানুষের চিন্তাদর্শন আরেকজন মানুষের চিন্তাদর্শনে পার্থক্যসম্পন্ন ও দ্বান্দ্বিক হলেও যুক্তির লড়াইয়ে কখনো সঠিক, কখনো তা বেঠিক হলেও মৌলিক নীতিমালাগুলো অভিন্ন (যেমন কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব জাকাত) বিষয়ে তাদের পথ অভিন্ন। এরকম দেখা যায়, সকল ধর্মের মানুষের মধ্যেই মত ভিন্নমত আছে। ইসলামে আছে শিয়া, সুন্নী, আছে দশটিরও অধিক স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গির ইসলামী রাজনৈতিক দল। আছে দেওবন্দী, আলীয়া, ওহাবী, সালাফী, আহালে হাদীস, তাবলীগী, সাদপন্থী তাবলীগী, সূফীবাদী, পীরপন্থী, মরমিবাদী, নানা মতের মানুষ যা আপনার মতের সাথে নাও মিলতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক মতের মানুষকে তাঁর মত নিয়ে নির্দ্বিধায়, নির্বিঘ্নে দেশে বসাবাস করার সুযোগ দিতে হবে। সর্বপ্রকার নিরাপত্তা দিতে হবে।
১৩ [ তেরো ]
কোনো মতের মানুষকে তার মতের জন্যে কটাক্ষ, উৎপীড়িত, উত্তোক্ত করা যাবে না। উৎখাত মনোবৃত্তির মূলোচ্ছেদ করতে হবে।
১৪ [ চৌদ্দ ]
অবাঞ্ছিত করতে হবে, নির্মূল করতে হবে, নিষিদ্ধ করতে হবে, দেশ থেকে নির্বাসন দিতে হবে, এই মুহুর্তে বাংলা ছাড় এইসব আক্রমণাত্মক কথা চিরতরে দূর করতে হবে।
নিষিদ্ধ করতে হবে শুধু চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, মদ, জুয়া, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, লোভ, লালসা, সকল প্রকার দূর্নীতি, দখলদারী, শোষণ, নির্যাতন, আধিপত্য, পুঁজিবাদ, মুনাফাখোরী, সিন্ডিকেট, দালালী, ধনীক বনীক শ্রেণীর আগ্রসন, লুটপাট, অর্থ ক্যালেংকারী, চোরা কারবারী, দখলবাজীর সকল পথ ঘাট।
১৫ [ পনেরো ]
কোনো রাজনৈতিক মত, কোনো ধর্মমত, বা একই ধর্মমতের বিভিন্ন তরিকা, মাজহাব, দল, উপদল, প্রক্রিয়াগত ভিন্নতার আলোকে সৃষ্ট দর্শন ও চিন্তার মানুষকে দর্শন দ্বারা আকৃষ্ট করতে পারবেন, কিন্তু আপনার মতে আনার জন্যে কোনো বল প্রয়োগ করা কিংবা অন্যেকে তার মতাদর্শের জন্যে কটাক্ষ করা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা, গালী দেওয়া, তার বাড়িঘর, তার উপাশনালয়, তাঁর চিন্তা দর্শনের স্তম্ভগুলোকে আঘাত করা, ভেঙে ফেলা, গুড়িয়ে দেওয়া ও একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজী করাকে প্রতিহত করা ও তাদের অধিকার সংহত করার বিধান বাস্তববায়ন করতে হবে।
১৬ [ ষোল ]
ডান্ডাবাজী, গুন্ডাবাজী, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টিকারী সকল প্রক্রিয়ার মূলোৎপাটন করতে হবে।
১৭ [ সতেরো ]
কথায় কথায় ধইরা লামু, মাইরা লামু, খাইয়া লামু, প্রভৃতি ভয় ও ত্রাস সৃষ্টিকারী পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে দূরীভুত করতে হবে।
১৮ [ আঠারো ]
প্রতিষ্ঠানসমূহে সর্বপ্রকার দলীয়করণ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করতে হবে৷ কেবলমাত্র রাজনৈতক দলসমূহের দলীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ বাদে সকল সরকারি বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্দলীয় সাধারণ সৎ, দেশপ্রেমিক ও নীতিবান লোক দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। তাঁর ব্যাক্তিগত সমর্থন একটা থাকলে সেটা থাকুক এটা তার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কোনো সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা, সক্রিয় কর্মী হতে পারবে না।
১৯ [ উনিশ ]
কারো ব্যাক্তিগত ফেইজবুক পেইজ ও এন্ড্রয়েড সেট কেবল তার নিজের। তার পেইজে সে যা খুশি পোস্ট করবে লিখবে এটা তার অধিকার। এ জন্যে তাকে কোনো প্রকার হেনস্তা, রাস্তায় মোবাইল চেক করে নির্দিষ্ট দলীয় ক্যাডার দিয়ে অপমান অপদস্ত করার সকল প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। এবং গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা বিরোধী ৫৭ ধারা সহ সকল কালো আইন, সকল বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করতে হবে।
২০ [ বিশ ]
আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষাকে জাতীয় ক্ষেত্রে পরস্পরের সহায়ক করতে হবে।
২১ [ একুশ ]
কাউকেই যখন তখন রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মৌলবাদী, সাম্প্রাদায়িক, কিংবা মাজার পুজারী, বেদাতি, কাফের ইত্যাদী যত নেগেটিভ নেরেটিভ আছে, এইসব শব্দে গালি দেয়া যাবে না৷ এবং কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যাবস্থা করতে হবে।
২২ [ বাইশ ]
উগ্রতা ত্যাগ করে এদেশে সব দল মতের, ধর্মের, সব চিন্তার মানুষ থাকবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মত, ধর্মমত, ইসলামপন্থী, শিয়াপন্থী, সুন্নীপন্থী, মাজারপন্থী, সুফি, বাউল, মরমী, ওহাবী, সালাফি, দেওবন্দী সবাই যার যার মত নিয়া থাকবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। বাধা দিলে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে না। যে কোনো রকম উস্কানীমূলক, বিদ্বেষমূলক, আক্রমণাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক, আঘাতমূলক আওয়াজ ও কথাবার্তা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে হবে। সকল প্রকার অপরাধ অন্যায়, অপকর্ম প্রতিহত করতে হবে।
শোষণমুক্ত সমাজ যেনো পাই
আমরা গরীব অন্য চাওয়া নাই,
কোটিপতি চাই না হতে তাই
নির্বিঘ্নে বাচতে শুধু চাই।
লেখক: ছড়াকার, কবি ও সাহিত্যিক।