বুধবার, জুলাই ২৩

২০ জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত মাইলস্টোনের শিক্ষিকা মেহরিন

|| রাজিব মিয়া | নিজস্ব প্রতিনিধি ||

নিজের জীবন বাঁজি রেখে ২০ জন শিশুকে রক্ষা করা সাহসী শিক্ষিকা মেহরীন চৌধুরীকে বাবা-মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। নীলফামারীতে জানাজা নামাজ শেষে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেলে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

গত ২২ জুলাই বেলা ৩টা ২০ মিনিটে তার লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্স। ৩টা ৫০ মিনিটে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার লাশ দাফন করা হয় বাবা-মায়ের
কবরের পাশে।

মেহরীন জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী রাজারহাট চৌধুরী পাড়া এলাকার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে। তার দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। স্বামী, সন্তান নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ও বাংলা ভার্সনের কো অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পরপরই ক্লাসরুম থেকে শিক্ষার্থীদের দ্রুত সরিয়ে ফেলেন মেহরিন। তাদের নিরাপদে বের করে দিতে গিয়ে নিজে আর সময়মতো বের হতে পারেননি। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া এক সেনা সদস্য বলেন, “ম্যাডাম ভিতরে ঢুকে গিয়ে বাচ্চাগুলারে বের করে দিছেন, তারপর উনিই বের হতে পারেন নাই।”

মেহরিনের উদ্ধার করা শিক্ষার্থীদের একজন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ছোয়া। তার বাবা সুমন বলেন, “আমরা জানি, ম্যাডাম না থাকলে আমাদের ছোয়া বাঁচত না।” ছোয়ার মামা জানান, “আমি খালি চুলপড়ে থাকতে দেখেছি, অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে দুজন আর্মি টেনে বাইরে নিয়ে আসে। অনেক খুঁজে পরে জানতে পারি, এক ম্যাডাম নাকি ছোয়াকে বের করতে সাহায্য করেছিল।” উদ্ধার হওয়া শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেছে, “ম্যাডাম বারবার বলছিলেন, দৌড়াও, ভয় পেও না। আমি আছি।” বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শিক্ষিকা মেহরিনের সাহসিকতায় অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়েছে।

মানবিকতা, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে রইলেন মেহরিন চৌধুরী। শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচিয়ে নিজে হারিয়ে গেলেন, একজন শিক্ষিকার এমন আত্মত্যাগ কোনোভাবেই ভোলার নয়।

স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ময়নুল হক ও গ্রামবাসী একরামুল হক জানান, তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ছিলেন। ঈদের সময় এলাকার মানুষদের ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা করতেন।

জানাজার আগে মেহরিনের স্বামী মনছুর হেলাল জানান, আমার স্ত্রীর সাথে শেষ কথায় তিনি জানিয়েছেন আমার সুস্থ্যভাবে ফেরার সুযোগ ছিল। যখন দেখছি আমার কঁচি কঁচি ছেলে মেয়েরা দগ্ধ হচ্ছে, পুড়ছে তখন আমি তাদের রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। অনেকে প্রাণে বেঁচেছেও। আমি যাদেরকে পেরেছি রক্ষার চেষ্টা করেছি। আমার জন্য দোয়া করিও। কিন্তু সে যে এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারিনি।

মেহরিনের ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী বলেন, আমার বোন মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ভবনে আগুন লাগার সময় তিনি আগে বের হননি, যতজন ছাত্র-ছাত্রীকে বের করে আনা যায় সে চেষ্টা করেছেন। তার দেহ পুড়ে গেছে বা যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখেননি। বাচ্চাদের বাঁচাতে সহযোগিতা করে গেছেন। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতেই তার মৃত্যু হয়।

জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, তিনি একজন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, সহজ-সরল। গত পরশু ওনার সাথে আমার বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ নিয়ে কথা হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিক প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষার মান্নোয়নে কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, এটি আমার গ্রামের স্কুল, এ স্কুলে অনেক স্মৃতি রয়েছে, এ স্কুলের জন্য কিছু করতে পারলে সেটি সম্মান ও গর্বের। কিন্তু তার এভাবে মৃত্যু হবে ভাবতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *