সোমবার, জুলাই ২৮

হারিয়ে যেতে বসেছে সলঙ্গার মৃৎশিল্প

|| মোঃ আখতার হোসেন হিরন | সলঙ্গা (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি ||

মাটির তৈজসপত্র বা মৃৎশিল্প বাঙালির পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এক সময়ের জনপ্রিয় এসব মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন আর তেমন তৈরি হয় না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি মাটির বিভিন্ন জিনিস পত্র। তবে পূর্ব পুরুষের মৃৎশিল্পের এ পেশাকে এখনও আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সলঙ্গা সদরের পালপাড়ায় মাত্র কয়েকটি পাল পরিবার। এক সময় পালপাড়ায় দিনরাত মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন প্রতিটি পাল বাড়ির লোকজন। কিন্তু বর্তমানে মৃৎশিল্পের চাহিদা দিনে দিনে কমে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকে। দারিদ্র্যতা যেন এইসব পাল সম্প্রদায়ের পরিবারে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে। তাদের ঘরে প্রায়ই অভাব অনটন লেগে থাকে। ফলে জীবিকার তাগিদে বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন পালরা।

এক সময় পালপাড়াতে পালরা রাতদিন জেগে মৃৎশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত থাকতো। ছিল ক্রেতা-বিক্রেতাদের জমজমাট কেনাবেচা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতেন। আগে যেখানে বেশ কয়েকটি পরিবার এ পেশায় কাজ করতো, এখন সেখানে কাজ করে মাত্র ৭/৮টি পরিবার। প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প। তবে গ্রামের নাম থাকলেও পূর্ব-পুরুষের রেখে যাওয়া মাটির জিনিসপত্র তৈরির নেই কর্মব্যস্ততা। আধুনিকতার যুগে কদর কমে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এ শিল্পটি।

পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শ্রী গোপাল পাল বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে মাটির তৈরি হাঁড়ি,পাতিল, শারা, ঢোকসা, কলস, ঘটি, ধুপতী, গাছাবাতি, মাটির ব্যাংক তৈরি করে আসছেন তিনি। সেই পণ্য বিক্রির টাকায় চলতো পুরো সংসার। এখন আর আগের মতো মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। কোনো মতে মাটির শারা, ঢোকসা বানিয়ে বিক্রি করেরে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

শ্রী সঞ্জয় কুমার পাল বলেন, এক সময় বাবার সঙ্গে রাত দিন জেগে হাড়ি-পাতিল বানিয়েছি। সেই সময় মাটির পাত্রের চাহিদা বেশিই ছিল। তখন ভালোভাবে আমাদের সংসার চলে যেত। এখন এ শিল্প নেই বললেই চলে। এ পেশায় আর কেউ থাকতে চায় না। গ্রামের অনেক ছেলে-মেয়েরা অন্য পেশায় চলে গেছে। কেউ মুদি দোকান করে ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে।

অনিতা পাল বলেন, এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে মাটি। সব মাটি দিয়েই মাটির জিনিসপত্র তৈরি করা যায় না। এসব তৈরির জন্য এটেল মাটির প্রয়োজন হয়। এ মাটি এখন পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। এত দামে মাটি কিনে পাত্র তৈরি করে সঠিক দামে বিক্রি হয় না। এ কারণে অনেক পালরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, খুব অল্প বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে এ কাজ শুরু করেছি। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে এ কাজ করছি। স্বামীর সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছি। কিন্তু এখন খুব কম চলে মাটির পাত্র। বাপ-দাদার কর্ম ছেড়ে যেতেও পারি না। তাই কোনো মতে কিছু বাসনপত্র বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চলে।

সুমন পাল জানান,ছোট বয়সে বাবা দাদার সঙ্গে মাটি নিয়ে খেলা করতে করতে এ পেশায় চলে এসেছি। এখন এ পেশায় দিন চলে। আগে মাটির জিনিসপত্রের বেশ চাহিদা ছিল। পরিবারের সবাই একসঙ্গে তৈরি করতাম। এরপর রোদ্রে শুকিয়ে তা পুড়িয়ে বিক্রি করতাম। এখন মাটি থেকে শুরু করে কয়লা, কাঠের অনেক দাম। বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য কাজ করার অভিজ্ঞাতও নেই। তাই বাধ্য হয়ে এখনও চালিয়ে যাচ্ছি।

বাসন কিনতে আসা আফরিন জানান, আগে সলঙ্গায় আসলে পালপাড়া থেকে প্রয়োজনীয় হাড়িপাতিল নিয়ে যেতাম, এখন বাসায় পর্যাপ্ত পরিমান সিরামিক ও প্লাস্টিক মালামাল থাকায় দিনদিন মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার অনেকটা কমিয়ে ফেলেছি। তবে মাঝে মাঝে এসে সখের বশে মাটির হাড়িপাতিল, মাটির ব্যাংকসহ কিছু জিনিস কিনে নিয়ে ঘর সাজাই।

পাল পরিবারদের দাবি, সরকার তাদের এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কমসুদে ঋণ দিয়ে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে আর্থিক সহযোগিতা করুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *