সোমবার, ডিসেম্বর ২৯

স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১% ভোটারের স্বাক্ষর বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন: ভোটের গোপনীয়তা কি ঝুঁকিতে?

|| জাহিদ খান | কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি ||

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে হলে মোট ভোটারের অন্তত ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জমা দেওয়ার বিধান নিয়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকদের মতে, এই নিয়ম ভোটের গোপনীয়তা ও নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আসনের মোট ভোটারের ১ শতাংশের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, এই শর্তের উদ্দেশ্য হলো ‘অপ্রয়োজনীয় বা অগুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’।

তবে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সচেতন নাগরিকদের প্রশ্ন—ভোটের আগেই ভোটারদের স্বাক্ষরের মাধ্যমে সমর্থন জানাতে বাধ্য করা কি কার্যত ভোটের আগাম ঘোষণা নয়?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটারকে কাকে ভোট দেবেন, তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপন থাকার কথা। কিন্তু সমালোচকদের মতে, স্বাক্ষর সংগ্রহের সময় ভোটারের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা নির্দিষ্ট প্রার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে ভোটের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।

একজন নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, “আইনগতভাবে বলা হতে পারে—স্বাক্ষর মানেই ভোট নয়। কিন্তু বাস্তবে ভোটার যখন কোনো প্রার্থীর পক্ষে স্বাক্ষর দেন, তখন তার রাজনৈতিক অবস্থান আগামভাবে নথিভুক্ত হয়ে যায়। এটি ভোটের অ্যানোনিমিটি বা গোপনীয়তার মূল দর্শনের পরিপন্থী।”

আগাম জনপ্রিয়তা প্রমাণের প্রশ্ন

নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট না পান, তাহলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এটিকে নির্বাচন পরবর্তী জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সমালোচকদের প্রশ্ন—যদি ভোটের ফলেই জনপ্রিয়তা নির্ধারণ হওয়ার কথা, তাহলে ভোটের আগেই কেন ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন প্রমাণ করতে হবে?

তাদের মতে, এই শর্ত নতুন, স্বতন্ত্র ও বিকল্প প্রার্থীদের জন্য একটি বাড়তি বাধা তৈরি করছে এবং নির্বাচনী প্রতিযোগিতাকে অসম করে তুলছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই নিয়ম বাস্তবে সুবিধা দিচ্ছে বড় রাজনৈতিক দলসমর্থিত বা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী প্রার্থীদের। অন্যদিকে, আর্থিক ও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল কিন্তু জনসমর্থন আছে—এমন অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এক নাগরিক অধিকারকর্মীর ভাষায়, “নির্বাচন হওয়া উচিত ভোটের মাঠে, স্বাক্ষরের কাগজে নয়। ভোটের আগেই প্রার্থী বাছাই করে দিলে সেটি আর পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র থাকে না।”

এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর বাধ্যবাধকতা পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে। তাদের মতে, জামানত ও ভোটের ফলাফলই জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এ ধরনের বিধান বহাল থাকলে ভবিষ্যতে নির্বাচনে নাগরিকের স্বাধীন অংশগ্রহণ ও বিকল্প রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সংকুচিত হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *