|| প্রফেসর ড. মোঃ ময়নুল হক, ইবি, কুষ্টিয়া ||
আল কুরআনের ভাষ্য হলো: فمن شهد منكم الشهر فليصمه রমজান মাস যে পেল সে যেন রোযা রাখে। সুরাতুল বাকারাহ: ১৮৫।
রমজান মাস পাওয়া অর্থ- রমজান মাসে জীবত থেকে যে ঐ মাসের চাদকে দেখতে পাবে তার উপর রোযা ফরয হবে। হযরত আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন: صوموا لرؤيته وٱفطروا لرؤيته،فإن غمي عليكم الشهر فعدوا ثلاثين চাদ দেখে তোমরা রমজানের রোযা রাখো এবং চাদ দেখে রোযা ভাংগো। যদি আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে/অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে/চাদ তোমাদের দৃষ্টি সীমার আড়ালে থাকে তাহলে মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন: لا تصوموا حتى تروا الهلال ولا تفطروا حتى تروه، فإن غم فٱكملوا العدة ثلاثين তোমরা রমজানের নতুন চাদ না দেখে রোযা রেখো না এবং শাওয়ালের নতুন চাদ না দেখে রোযা রাখা ছেড়ে দিওনা। চাদ তোমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে থাকলে মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো।(বুখারী মাআল ফাতহ,৪/১১৯ ও মুসলিম মাআ শারহুন নববী,৭/১৯৩)।
সূর্য্য ও চাদ সম্পর্কে পবিত্র কুর আনের বক্তব্য হলো: الشمس و القمر بحسبان সূর্য্য ও চাদ হিসেব মতে চলাচল করছে।( সূরা আর রহমান: ৫)। অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন: هو الذي جعل الشمس ضياء والقمر نورا وقدره منازل لتعلموا عدد السنين و الحساب তিনি (আল্লাহ তাআলা) সূর্য্যকে দীপ্তিমান করেছেন এবং চাদকে করেছেন আলোকময় এবং এর গতির জন্য মঞ্জিলসমূহ নির্ধারণ করেছেন যাতে তোমরা বছরসমূহের সংখ্যা ও হিসেব জানতে পারো (সূরা ইউনুস:৫)। (যাদের কারণে দিন ও রাত হয়, গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের বিবর্তন ঘটে, নদীতে জোয়ার ও ভাটার সৃষ্টি হয়। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সূর্য্যের জন্য দিয়া, এবং চাদের জন্য নূর, শব্দ ব্যবহার করে ইংগিত দিয়েছেন চাদের নিজস্ব কোন আলো নেই। আমরা যেটা দেখি তা সূর্য্যর কিরণের প্রতিফলন চাদের উপর।)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: يسئلونك عن الٱهلة قل هي مواقيت للناس و الحج চাদ সম্পর্কে তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছে, আপনি বলুন: চাদ হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন কাজের জন্য এবং হজ্জের বিধানাবলী প্রতিপালনের জন্য সময় নির্ধারক।(সূরাতুল বাকারাহ:১৮৯)।
চাদ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট বক্তব্য হলো: و القمر قدرناه منازل حتى عاد كالعرجون القديم আর আমি চাদের জন্য কতিপয় মনযিল নির্ধারণ করেছি যেগুলোকে ঘুরে ফিরে আসে ক্ষীণ হয়ে পুরাতন খর্জুর শাখার ন্যায়। (সূরা ইয়াসিন:৩৯)।
মুফিসসিরীনের বক্তব্য হলো চাদের এ মনযিল বা স্টেপগুলো ২৮টি যা চাদ ২৮ দিনে অতিক্রম করে। মাস ২৯ দিনে হলে ১ দিন, আর মাস ৩০ দিনে হলে ২ দিন চাদ লুকায়িত থাকে। এ নিয়মে চাদ ২৪ ঘন্টায় একবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এবং ২৮ দিনে ২৮টি উদয়স্থল থেকে উদিত হয়, একই কাজ করতে সূর্য্যের সময় লাগে এক বছর ৬ ঘন্টা।
চাদের এই মনযিল বা স্টেপগুলোর কারণে উদয়স্থলের ভিন্নতা দেখা দেয় যাকে আরবীতে বলা হয় اختلاف المطالع (ইখতেলাফুল মাতালেঈ) যার স্বীকৃতি দিয়েছেন সকল ইমাম, ফকিহ, আলিম, মুজতাহিদ ও বিজ্ঞজন। চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতার বিষয়ে সবাই একমত হলেও চাদ দেখার ব্যাপারে এটি ধর্তব্য হবে কী হবে না এ নিয়ে প্রাচীন ও আধূনিক ফোকাহার মাঝে রয়েছে প্রচণ্ড মতবিরোধ এবং এতে দুটি ধারা লক্ষণীয়:
১. রমজান মাসের চাদ যে কোন শহর বা দেশে দেখা গেলে সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর উপর রোযা রাখা ফরয হবে। চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হবে না। এ মতের পক্ষে রয়েছেন অধিকাংশ হানাফী, হাম্বলী ও মালেকী আলিমগণ।(ইবনুল হুম্মাম, ফাতহুল কাদীর, ২/২৪৩, মুরাদাভী, আল ইনসাফ, ৭/৩৩৫, আল বাজী, আল মুনতাকা ,২/৩৭, আল ইরাকী, ত্বরহু্ত তাছরীব,৪/১১৬)।
২. চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে যখন যে দেশে চাদ দেখা যাবে তখন সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর রোযা পালন ফরয হবে। দূরবর্তীদের জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য হবে না। এ মতের পক্ষে রয়েছেন অধিকাংশ শাফেঈ, কতিপয় মালেকী ও হানাফী আলিম এবং উপমহাদেশের অধিকা়শ আলিমগণ।(আন নববী, আল মাজমুউ,৬/২৮০-২৮১)।
প্রথম পক্ষের দলীল উপর্যুক্ত প্রথম আয়াত ও দুটি হাদীস যা কোন নির্দিষ্ট এলাকাকে সম্বোধন করা হয়নি অর্থাৎ আম তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সম্বোধন করা হয়েছে। চাদ চাক্ষুশ দেখা বা হুকমান দেখা অর্থাৎ কোন এক জায়গার লোক দেখা সমগ্র দুনিয়ার মুসলিমদের দেখা হিসেবে গণ্য হবে। চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হবে না।
কাছাকাছি এলাকার ক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখার সাক্ষ্য অন্য জায়গার জন্য কবুল করা মারফূ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত
আবু উমাইর ইবনু আনাস রা. বলেন, আমাকে আমার আনসারী চাচাগণ, যারা সাহাবী ছিলেন, হাদীস বর্ণনা করেছেন যে-
قالوا : أغمي علينا هلالُ شوال، فأصبحنا صياما، فجاء ركب آخر النهار، فشهدوا عند رسول الله صلى الله عليه وسلم أنهم رأوا الهلال بالأمس، فأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم الناسَ أن يُفْطِروا ويَخْرُجُوا إلى عيدهم من الغد.
একবার মেঘের কারণে শাওয়ালের চাঁদ আমাদের দৃষ্টিগোচর হল না। ফলে পরদিন আমাদের সকাল হল (রমযানের ত্রিশতম) রোযা অবস্থায়। দিনের শেষে এক কাফেলা এল এবং আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে সাক্ষ্য দিল যে, তারা গত রাতে চাঁদ দেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. লোকদের আদেশ করলেন, এখন রোযা ভেঙ্গে ফেল আর আগামীকাল ঈদের জন্য বের হও। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৯৫৫৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৩৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৫৩; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী খ. ৩, পৃ. ৩১৬; খ. ৪, পৃষ্ঠা ২৪৯) ইমাম বায়হাকী রহ. এ হাদীসের সনদকে সহীহ ও ‘হাসান’ বলেছেন। সর্বাবস্থায় তা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। শব্দের কিছু পার্থক্যের সাথে এ হাদীস সুনানে আবু দাউদ (১১৫০), সুনানে নাসায়ী (১৭৫৬), মুসনাদে আহমদ খ. ৫, পৃ. ৫৭, ৫৮) ও সহীহ ইবনে হিববানেও (৩৪৫৬) আছে।
দ্বিতীয় পক্ষের দলীল উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ যেখানে বলা হয়েছে চাদ দেখে রোযা রাখবে এবং চাদ দেখে রোযা রাখা ছেড়ে দেবে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন/অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে/চাদ লুকায়িত থাকে ২৯ শাবান/২৯ রমজান চাদ দেখা না যায়, তাহলে শাবানের ত্রিশ/রমজানের ত্রিশ পূর্ণ করবে।
চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চাদ দেখা যেতে পারে যেমনটি হাদীসে কুরাইবে উল্লেখিত হয়েছে:
عن كريب ٱن ٱم الفضل بنت الحارث بعثته إلي معاوية بالشام قال فقدمت الشام فقضيت حاجاتها و ٱنا بالشام فرٱيت الهلال ليلة الجمعة ثم قدمت المدينة. في ٱخر الشهر فسٱلني عبد الله بن عباس ثم ذكر الهلال فقال متى رٱيتم الهلال؟ فقلت رٱيناه في ليلة الجمعة فقال ٱنت ىٱيته قلت نعم، رٱه الناس و صاموا وصام معاوية فقال لكنا رٱيناه ليلة السبت فلا نزال نصوم حتى نكمل ثلاثين ٱو نراه فقلت ٱو نكتفي برؤية معاوية و صيامه؟ فقال لا، هكذا ٱمرنا رسو ل الله صلي الله عليه و سلم كلمة تصريح برفع ذلك إلي النبي صلي الله عليه و سلم و بٱمره.
এ হাদীসের ভাষ্যমতে কুরাইব রা.কে উম্মুল ফদল বিনতুল হারেস সিরিয়ায় মুয়াবিয়া রা. এর নিকট পাঠান।সেখানে গিয়ে তার কাজ শেষে শুক্রবার রাতে রমজানের চাদ উদিত হয় দেখতে পান এবং রোযা রাখেন। মাসের শেষের দিকে তিনি মদীনায় ফিরে এলে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. চাদ সম্পর্কে জানতে চান। তখন কুরাইব রা. বলেন আমরা শুক্রবার রাতে চাদ দেখে রোযা রেখেছি, মুয়াবিয়া রা.ও রোযা রেখেছেন। ইবনু আব্বাস রা.বল্লেন আমরা শনিবার রাতে চাদ দেখে রোযা রেখেছি আমরা ত্রিশ রোযা পূর্ণ করবো অথবা চাদ দেখে সিদ্ধান্ত নিবো। কুরাইব রা. বল্লেন মুয়াবিয়া রা. র চাদ দেখা ও রোযা পালন আমাদের জন্য কী যথেষ্ট নয়? তিনি বল্লেন না, রাসূল সা.সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদেরকে এ রকমই নির্দেশ দিয়েছেন। সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমদসহ হাদীসের অনেক কিতাবে এ হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শামে চাঁদ দেখার সংবাদ মদীনাবাসী জানতে পেরেছেন অনেক পরে। শাম (দামেশক) মদীনা থেকে স্থলপথে ১৯২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর দামেশক ৩৩̊ উত্তর অক্ষাংশে, ৩৬̊ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এবং মদীনা ২৪̊ উত্তর অক্ষাংশে, ৩৯̊ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।
উপরোক্ত হাদীস প্রমাণ দিচ্ছে একই খেলাফতের অধীনে বিভিন্ন শহরে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা পালিত হয়েছে যা চাদ দেখার উপর ভিত্তি করে। প্রথম পক্ষ এটিকে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. এর ইজতিহাদ বলেছেন। কিন্তু এটি মারফুউ হাদীস যা রাসূল সা. এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করা হয়েছে। কাজেই যে দেশে চাদ দেখা যাবে সেখানে বা তার নিকটবর্তী এলাকায় রোযা ফরয হবে, দূরবর্তী এলাকার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। (কুরত্বুবী, আল জামেঈ লে আহকামিল কুরআন, ২/২৯৫)।
এ মতের পক্ষে রয়েছেন ইকরামা রা.মাওলা ইবনু আব্বাস,কাসেম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবি বকর সিদ্দীক রা. সালেম ইবনু আব্দুল্লাহ ইবন ওমার রা. ইসহাক ইবনু রাহবিয়া প্রমুখ (ইবনু হাজর, ফাতহুল বারী, ৪/১২৩)। ইমাম বুখারী রহ. তার কিতাবের একটি পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছেন: প্রত্যেক দেশের জন্য তাদের চাদ দেখা প্রযোজ্য হবে।
ইমাম যায়লাঈ বলেছেন: হানাফী মযহাব হলো চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য হবে না। তবে অন্যভাবে বলা হয়ে থাকে ধর্তব্য হবে কারণ প্রত্যেকটি দেশের মানুষ সম্বোধিত তাদের বিষয়াবলীর উপর। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চাদের উপর সূর্য্যের প্রতিফলিত রশ্মির বিচ্ছিন্নতায় চাদ দেখা যাওয়া বা না যাওয়ার ভিন্নতা তৈরী করে।(যায়লাঈ, তাবিনুল হকাইক,১/৩২১)
ইবনু হাজর আসকালানী উল্লেখ করেছেন: দুটো নতুন চাদের মাঝখানের সময়কালটাই মাস হিসেবে গণ্য। কাজেই দিন সাব্যস্ত হলে সকল হুকুম প্রযোজ্য হবে। নস ও ইজমা দ্বারা রোযা আবশ্যকীয়।(ইবনু হাজর, ফতহুল বারী, ৪/১২৩)
পৃথিবীবাসী একমত যে চাদ একরাতেই দেখা যায়। কোন দেশে চাদ দেখা গেলে তার পূর্ব দিগন্তে অবস্থানকারী দেশগুলোতে তা প্রকাশ পায় না। কারণ সে চব্বিশ ঘন্টায় তার ঘূর্ণায়ন সমাপ্ত করে যা সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে। স্বাভাবিকভাবে পূর্বদিগন্তে অবস্থানকারী দেশগুলোতে চাদ পরের রাতে দেখা যায়। আমাদের উপমহাদেশের অবস্থানগত কারণে পরের রাতে আমরা চাদ দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের চেয়েও দূররবর্তী দেশ মালয়েশীয়া ও ইন্দোনেশিয়া সৌদিআরবকে অনুসরণ করে রমজানের রোযা ও দুই ঈদ পালন করে থাকে। মূলত এখানে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ তাদের উদ্দেশ্য। যৌক্তিকতা হলো চাদ দেখার খবর মূহূর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ায় পৌছানো সম্ভব এবং হজ্জের বিধানাবলী সৌদির দেখা চাদ অনুযায়ী প্রতিপালিত হয়ে থাকে।
রাসূল সা. এর যুগ থেকে আজ অবধি সারা পৃথিবীর মুসলমান একই দিনে রোযা শুরু করেছেন ও ঈদ পালন করেছেন একই দিনে এমনটা কখনই ঘটেনি। চাদের উদয়স্থলের ভিন্নতায় একেক দিন একেক মনযিল থেকে যদি উদয় হয় তাহলে চাদ দেখার বিষয়টি মুখ্য। চাদের এক দিন বা দুই দিন লুকায়িত থাকার বিষয়টি প্রাকৃতিক বাধা ধরা নিয়ম যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে। লুকায়িত থাকার অর্থ হলো চাদের উপর সূর্য্যের আলো মাসে ১/২ দিন পড়ে না, ফলে চাদের অস্তিত্ব পৃথিবীর কোন প্রান্তের আকাশেই দৃশ্যমান হয় না। (ভাবতে অবাক লাগে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে রাসূল সা. বলে গেলেন: فإن غم فٱكملوا العدة ثلاثين চাদ তোমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে থাকলে মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো।)
ঠিক অনুরূপভাবে সূর্য্য তার ঘূর্ণায়ন পথপরিক্রমায় সময়ের ব্যবধান তৈরী করে দিয়েছে। আমাদের সাথে সৌদিআরবের সময়ের বাবধান তিন ঘন্টা। এ ব্যবধান মেনে আমরা সৌদি আরবের আগেই নামায আদায় করি, রমজানের সাহরী ও ইফতার খেয়ে থাকি। আমরা চাইলেই সৌদিআরবের অনুসরণ এসব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরে চলেছে প্রতিনিয়ত। যাকে আমরা আহ্নিক গতি বলে জানি। ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিক বা অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ (Anti Clockwise) হলো গতি। চাঁদ ধীরে ধীরে আবর্তন করছে পৃথিবীকে। ফলশ্রুতিতে প্রতিদিন পশ্চিম দেশ সবার আগে চাঁদের উন্মোচন দেখতে পায়। সূর্যোদয় হয় পূর্ব থেকে, তবে চাঁদের ক্ষেত্রে উল্টো। যদিও চাঁদ পূর্বে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়, তবুও পশ্চিমারা চাঁদের আলো সবার আগে পায়। কেননা খালি চোখে চাঁদকে দেখতে হলে চন্দ্র আর সূর্যের মাঝে ১০.৫ ডিগ্রি কোণ থাকতেই হবে এবং যে পরিমাণ দূরত্ব অর্জন করলে এই কোণ তৈরি হবে, সে পরিমাণ যেতে যেতে চাঁদের ১৭ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়- এ কারণেই আজ কোন দেশে চাঁদ দেখা গেলেই যে বাংলাদেশেও দেখা যাবে, সেটা ভুল ধারণা। যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই কোণ অর্থাৎ ১০.৫ ডিগ্রি অর্জন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাবে না। একই বিষয় সৌদি আরব ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। এই সংকট কোণকে ইলঙ্গেশন (Elongation) বলে। ফলে চাঁদের বয়স কত সেটা আদৌ আসল কথা নয়, সেই কোণ হয়েছে কিনা সেটার উপর নির্ভর করে চাঁদ দেখা যাবে কিনা। আমরা সৌদি আরব থেকে ৩ ঘণ্টা সূর্যের হিসেবে এগিয়ে থাকলেও, চাঁদের হিসেবে ২১ (২৪-৩=২১) ঘণ্টা পিছিয়ে আছি। ২১ ঘণ্টা প্রায় ১ দিন। অর্থাৎ আমরা প্রায় একদিন পিছিয়ে আছি। সেজন্যই সৌর বছরের হিসেবে একদিন পরে চাঁদ দেখি।
আল্লাহর রাসূল সা. এর বক্তব্য এ ক্ষেত্রে একেবারেই সুস্পষ্ট صوموا لرؤيته و ٱفطروا لرؤيته চাদ দেখে রোযা রাখ চাদ দেখে রোযা ভাংগো। রোযার বিধান চাদ দেখার উপর নির্ভরশীল। চাদ দেখার বিষয়টি চাক্ষুশ যা রুইয়াত শব্দ দিয়ে আল্লাহর রাসূল সা. বুঝিয়েছেন। চাদ যখন উদিত হয় তখন সে খুবুই ক্ষীণ থাকে এবং আকাশে তার অস্তিত্বকালও হয় সংক্ষিপ্ত সৌদিআরবের দেখা চাদ পশ্চিমে অবস্থিত দেশুলোর পক্ষে দেখার সম্ভাবনা থাকলেও পূর্বদিকে অবস্থিত দেশুলোর কোন সম্ভবানা নেই। চাদ ২৪ঘন্টায় পৃথিবী ঘুরে আসে স্বাভাবিকভাবে পূর্বদিকের দেশুলো অতিক্রম করতে তার দিনের বেলা পেরিয়ে যায় ফলে পর দিন রাতে চাদ দৃশ্যমান হয়। এ বাস্তবতার নিরিখে আমাদের দেশে চাদ দেখার মাধ্যমে রোযা ও দুই ঈদ পালন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং এটাই সঠিক পন্থা বলে আমি মনে করি।
চাদপুরসহ দেশের আরো কয়েকটি জায়গায় সৌদিআরবের অনুকরণে রোযা ও দুই ঈদ পালন করা হচ্ছে যা একই দেশে দু্ধরনের পরিবেশ তৈরী করে বিশৃংখলার জন্ম দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশীয় হিসেব মতে শাবান মাস ২৯ দিনে হলে সৌদির অনুসরণে রোযা পালনকারী ব্যক্তি ঐ দিন রোযা রেখে পাপ কামাচ্ছেন। আর যারা সৌদির অনুসরণ করে রমজানের ২৯তম রোযা না রেখে সৌদি আরবের দেখা শাওযালের চাঁদ দেখে খাই দাই করে আনন্দ উৎসব পালন করে অনুগত মানুষজনকে জাহান্নামের পথে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? এসব প্রশ্নের উত্তর যারা দিবে তারাইতো আজ শতধাবিভক্ত। জাতির মাথায় পচন ধরেছে- রুখবে কে? সাধ্যি কার ? বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধতা ফিরিয়ে আনার জন্য সচেতন আলিম সমাজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক: অন্যতম জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।