বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

সুফি মেডিটেশন : আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু

‘যে ব্যক্তি তার আত্মাকে বিশুদ্ধ রেখেছে, সে-ই তার জীবনকে সার্থক করে তুলেছে। আর যে ব্যক্তি তার আত্মাকে কলুষিত করে ফেলেছে, সে তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।’ (সুরা শামস, আয়াত-৯-১০) সুতরাং এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আত্মার পবিত্রতা অর্জন করাই ইসলাম প্রতিপালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এটাই শরিয়তের মর্মভেদ-মর্মকথা। আত্মাকে অপবিত্র করে ফেলাই ইসলাম তথা শরিয়ত বিচ্যুতির প্রধানতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মানবজীবন হয়ে পড়ে নিরর্থক ও নিষ্ফল। আর এই বিফলতাই বয়ে আনবে পারলৌকিক জীবনে হতাশা ও ধ্বংস। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মসাধনার মাধ্যমে জীবনকে সার্থক করে তোলার নামই জান্নাত বা আনন্দময় জীবন। আত্মসংগ্রাম বা আত্মসাধনার নামই তাসাউফ বা সুফিতত্ত্ব। কাজেই তাসাউফতত্ত্বের জন্মকাল ইসলামের জন্মকাল থেকেই শুরু হয়েছে। তাসাউফ-পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের সময় থেকেই শুরু হয়েছে।

তাযকিয়া, ইসলাহে নফস, ইহসান কিংবা তাসাওউফ- এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য একই। শরীয়তের সব আমলেরই যাহেরী এবং বাতেনী দিক রয়েছে। বাতেনী বা অভ্যন্তরীণ দিক দেখা যায় না। এটি ব্যক্তির অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মূলত এর ওপরই আমলের ফলাফল নির্ভর করে। এ জন্য অন্তরের পরিচর্যা করা-তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করাকে প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয করা হয়েছে। সঙ্গতকারণেই এর পথ ও পদ্ধতি জানা প্রয়োজন।

মানুষের চেতনায় এমন এক আলো আছে, যা বাহ্যিক বস্তু (জাহির) বা সত্তার সুপ্তাবস্থার অভ্যন্তরীণ মাত্রা (বাতিন) পর্যবেক্ষণ করতে পারে। গুপ্ত জগতের (গায়েব) পর্যবেক্ষণ বাহ্যিক জগতের যে কোনো সত্তাকে প্রকাশ করতে পারে। নবী-রসুলগণ (আ.) এই আলো দিয়ে বাহ্যিক শনাক্ত করতে পারতেন। প্রিয় নবীজি (দ.) এই আলোকে বলেছেন, অন্তরের আলো বা নূরে ফিরাসাত। অন্তরের আলো আমাদের অভ্যন্তরে অনুপস্থিত, সেকারণে জীবনযাপন আরও জটিল হয়ে উঠছে। ইন্দ্রিয়গুলো উদ্দীপিত হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। ইবাদত-বন্দেগীর গুণমান কমিয়ে দেয়। আল্লাহকে স্মরণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? এর জন্য দরকার মনোযোগী হওয়া এবং মননশীলতার অনুশীলন। আর এ কারণেই সুফি মেডিটেশন।

আপনি কি কখনও নিজের ভিতরে একটি বিরক্তিকর অনুভূতি টের পান? কিংবা জীবনে এখনও আরও কিছু বাকি আছে বলে মনে হয়? আপনার প্রিয় মানুষদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও কি এক ধরনের একাকিত্ব অনুভব করেন? আপনি কি কখনও নিজেকে জিজ্ঞাসা করে দেখেছেন জীবনের উদ্দেশ্য কী? কীভাবে আপনি উদ্দেশ্যের সঙ্গে জীবন শুরু করতে পারেন? কীভাবে আপনার আত্মা এবং মহাবিশ্বের সাথে সংযোগ করতে পারেন? কীভাবে নিজের আধ্যাত্মিক জাগরণ লাভ করতে পারেন?

সভ্যতার আদি থেকে মানুষ জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে আসছে। স্বপ্ন সার্থক করতে গ্রহণ করছে নানা মতবাদ, পদ্ধতি, নীতি ও আদর্শের। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আজও অধরা। নেই তৃপ্তি। জগতের কোনো কিছুই দুঃখ-যন্ত্রণা-দারিদ্র্য থেকে মানবজাতিকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে পারছে না। যাবতীয় সব চেষ্টা আংশিক বা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে হতে মানবমন আজ অস্থিতিশীল। প্রশ্ন জাগে, কেন এই ব্যর্থতা? এটির উত্তর অন্বেষণ করা চাই। তার জন্য পৌঁছাতে হবে অস্তিত্ব এবং চৈতন্যের গভীরে। সুফি মেডিটেশন সেই অন্বেষণে আপনার সহযোগী।

আমরা অনুসন্ধান যুগের মানুষ। ঐশ্বর্যের সন্ধানে এবং আবিষ্কারের জন্য আমরা সমুদ্রের তলদেশে যাই, সর্বোচ্চ পর্বতের উচ্চতা মাপি, এমন কি অন্যগ্রহের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করি। একই অভিপ্রায়ে আমরা ভ্রমণ করতে শুরু করি আমাদের নিজেদের চেতনার গভীরে। আমাদের ভেতরে আমরা নিজেরা ছাড়া আর সব আছে। ভয় আছে, সংস্কার আছে, লোভ আছে, যন্ত্রণা আছে, মিথ্যা আছে, অতীত আছে, স্বপ্ন আছে, কল্পনা আছে, আছে আরো অনেক মানুষ, অনেক কোলাহল। আমার ভেতরে আমি নাই জন্যই এত কোলাহল আর এত অশান্তি। সুফি মেডিটেশন মানে নিজেকে টুকরো টুকরো করে জানার সাধনা। দেহ-মনে জমে থাকা বহু বছরের বিকার, যাতনা ও ব্যাধি থেকে মুক্তির সহজ উপায়।

মূলত ইসলামের পুরোটাই আধ্যাত্মিকতার আবরণে ঢাকা। জাগতিক যা কিছু করা হয়, সবই এমন এক সত্তার সন্তুষ্টির জন্য, যার কোনো কিছুই আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। সঠিক উপলব্ধি, অন্তরের বিচার-বিবেচনা ও পরিশেষে বিশ্বাস ও নির্ভরতা আমাদের এই সন্তুষ্টি তালাশে ব্যস্ত করে তোলে। ঈমান যতই বাড়ে, ততই তার সামনে সেই রাজ্যের পরিসর উন্মুক্ত হতে থাকে। সেটি অস্তিত্বহীন নয়, বরং সেটি উপলব্ধির রাজ্য। তাসাওউফের সঠিক দীক্ষা ছাড়া সে রাজ্যে ভ্রমণ সম্ভব নয়।

নবী-রাসুলদের ইসলাম প্রচারের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মানবাত্মাকে জাগতিক আবিলতা ও কলুষতা থেকে পূত-পবিত্র রাখা। আত্মাকে পূতপবিত্র রাখার সর্বপ্রধান উপায় হলো আত্মাকে পারলৌকিক ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা। জাগতিক আত্মবিস্মৃতির ফল থেকেই আত্মা হয়ে ওঠে নির্মল ও নিষ্পাপ। এরূপ আত্মসাধনায় ব্রতীগণই ইসলামের পরিভাষায় সুফি নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। সুফিসাধনায় রয়েছে কাম, ক্রোধ, মোহ, মাৎসর্য, জাগতিক লোভ-লালসা, ভালোবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, আত্ম-অহং, মিথ্যা, প্রতারণা প্রভৃতি পাশবিক প্রবৃত্তি ও প্ররোচণা থেকে বিরত থাকা বা চির নিবৃত্ত হওয়ার নামই সুফিসাধনা। তাযকিয়ায়ে নফস, ইসলাহে নফস তথা আত্মশুদ্ধি বা আত্মবিশোধন বলা হয়।

আত্মিক বোধকে জাগ্রত ও বিকশিত করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো সুফি মেডিটেশন (ধ্যান)। এর মাধ্যমে আমরা সেইসব শক্তির পর্যবেক্ষণ করতে পারি যেগুলো আমাদের দৈহিক বোধের ঊর্ধ্বে। ভিন্ন ভিন্ন রূপে মানব-ইতিহাসের পুরোটা জুড়েই এর অস্তিত্ব ছিল। আধ্যাত্মিকতা, বাস্তব জীবনের উন্নতি, স্বাস্থ্য বা ফিটনেস যাই হোক না কেন— আপনার আকাঙ্ক্ষা অর্জনে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্যেই এই সুফি মেডিটেশন।

0 Comment

  • খাজা ওসমান ফারুকী (খাজা’জী) উদ্ভাবিত সুফি মেডিটেশন মেথড জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র আধ্যাত্মিকতার অঙ্গন হিসাবে নেওয়া তাই সুফি মেডিটেশন মেথড এর মূলমন্ত্র হলো— সমগ্র জীবনই আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিক মাত্রা ব্যতীত, প্রতিদিন যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তার সাথে টিকে থাকা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি যেমন হয় তেমনি জাগতিক উন্নয়নও তার অনুসারী হয়। আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ছাড়া মানুষের যেমন মানসিক বিকাশ সম্ভব হয় না তেমনি পরম স্রষ্টা আল্লাহকে পূর্ণরূপে উপলব্ধিও করা যায় না। আত্মার শক্তি বিকাশের জন্য সব সময়ই প্রয়োজন অনুধ্যান বা মেডিটেশন ও জ্ঞান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *