শনিবার, মার্চ ১৫

সিরাজগঞ্জে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, অভিযানের নামে চলছে ছিনতাই!

|| আল-আমিন হোসেন | স্টাফ রিপোর্টার ||

“সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের সোর্স দিয়ে চলে তল্লাসি” শিরোনামে কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায় হাঁটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কর্মকর্তারা গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কথিত সোর্সদের গায়ে রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট (বিশেষ পোশাক)পড়িয়ে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসের যাত্রীদের ব্যাগসহ শরীর তল্লাসি করাচ্ছেন। ‘কোনো সোর্স দপ্তরের পোশাক পরে কারও ব্যাগ, সম্পত্তি বা শরীর তল্লাশি করতে পারবেন না। এটা আইন পরিপন্থি। পুরোপুরি অবৈধ।’

খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড নিয়ে জেলায় চলে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা।এরই মধ্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের আইন বহির্ভূত অনৈতিক সব কর্মকাণ্ড। মাদক নিয়ন্ত্রণের বদলে স্বর্ণ, অলংকার ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

সিরাজগঞ্জে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, অভিযানের নামে চলছে ছিনতাই!
ছিনতাইকৃত দুটি সোনার বার ফেরত নেওয়ার অঙ্গীকারনামা

অভিযোগ উঠেছে, কথিত সোর্সদের দিয়ে অভিযানের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। অনেক সময় চোরাচালান পাচার করা, ধরা পড়া মূল্যবান ধাতুও ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে বিষয়টির সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাজশাহী বিভাগের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর ভোরে সিরাজগঞ্জ হাটিকুমরুল গোলচত্বরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের একটি অভিযানে তল্লাসির সময় মানিকগঞ্জ জেলার আল আরাফাত নামে এক প্রাইভেটকারের যাত্রীর নিকট হতে একটি ১১ ভরি ও আরো একটি ১০.৪ ভরি দুটি স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেয় অধিদপ্তরের কতিপয় সোর্স ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কর্মকর্তারা। এ অভিযানের টিম লিডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন পরিদর্শক ইব্রাহিম খলিল। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে নানা নাটকীয়তা শেষে ৪৮ ঘন্টা পর স্বর্ণের বারের কাগজপত্র যাচাই বাছাই ছাড়াই মুসলিকা নিয়ে স্বর্ণের বার দুটি ফেরত দেওয়া হয়। উদ্ধারের পর নিয়ম অনুযায়ী কাস্টম বা কোর্টের মাধ্যমে সোনা ফেরত দেবার বিধান থাকলেও অজ্ঞাত কারণে কোনটাই মানা হয়নি সে সময়।অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের কারণেই যাচাই বাছাই করা হয়নি সোনার বার দুটির কাগজপত্র ও জানানো হয়নি কাস্টম বা প্রশাসনকে।

পরে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ও নিজের দায় ঠেকাতে স্বর্ণের বারের মালিকের লিখিত অভিযোগ ছাড়াই সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুহুল আমিন সেদিনের ঘটনায় টিম লিডারসহ মোট চারজনকে অভিযুক্ত করেন। এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলা হয় দপ্তরের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে সোর্স ও উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা নিজেরা বাঁচতে এ ঘটনার দায় চাপিয়েছে নিম্ন কর্মকর্তাদের উপর।
এ ঘটনার পর থেকে সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও সিপাহীদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ চলে আসছে।ফলে অফিসে এ ঘটনার পর থেকে কেউ কারও কামান্ড মানছেন না। এছাড়াও অভিযুক্তদের অভিযোগপত্রে সোনার ওজন আর সোনা ফেরতের অঙ্গিকার নামার ওজনেও রয়েছে গড়মিল।

(ছবির ক্যাপশন:ছিনতাইকৃত সোনার বার দুটি ফেরত দিচ্ছেন সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুহুল আমিন)
টিম লিডার উপপরিদর্শক মোঃ ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা

সোনার বার দুটির স্বত্বধিকারী ভুক্তভোগী আল আরাফাত বলেন, সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের সোর্স ও কর্মকর্তারা মাদকদ্রব্য অভিযানের নামে জোরপূর্বকভাবে আমার দুটি সোনার বার কেড়ে নিয়ে চলে যায়। বারবার তাদের নিতে নিষেধ করলেও তারা এ বিষয়ে কোন কর্ণপাত করেননি। এ ঘটনার পর সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের উপ পরিচালককে অবগত করলে তারা পরে আমাকে বার দুটি ফেরত দেয়। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারবো না।

এ ঘটনার পর স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ মোতাবেক স্বর্ণের মতো মূল্যবান ধাতু বাজেয়াপ্ত বা ফেরত দেওয়া এখতিয়ার নেই জেলা অফিসের। অভিযোগ আছে অসাধু কর্মকর্তা আর সোর্সদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সময়ে আইন বহির্ভূত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে জেলায়।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত সিপাহী সোহেল রানা বলেন, লিখিত কোন ডকুমেন্টস্ নেই, কোন লিখিত অভিযোগও নেই। অথচ আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে কথিত সোর্সরা। আর মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।

এ ঘটনায় আরেক সিপাহী আকমল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কে বা কাহারা সোনার বার ছিনতাই করলো, আবার কেই বা ফেরত দিলো আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি শুধু অভিযানের রেইডিং টিমে ছিলাম। আমার নামে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।আমি একজন নিরপরাধ ব্যক্তি, আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই ।

এ ব্যাপারে আরেক অভিযুক্ত সহকারী উপপরিদর্শক মীনা পারভীন বলেন, যেহেতু আমি অভিযানের টিমের সাথে ছিলাম সেই জন্যই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগ দিলেও কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক এবং ওই অভিযানের টিম লিডার ইব্রাহিম খলিল বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে উপ-পরিচালক মহাদয় সবকিছুই জানেন তিনি ভালো বলতে পারবেন।সোর্সের কাছ থেকে স্বর্ণের বার দুটি উদ্ধার করা হয়।আমি এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিলাম না। টিম লিডার হিসেবে সঠিক তদারকি করতে পারিনি বলে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি ঐ ঘটনার পরে কৌশলে বার দুটি উদ্ধার করে মূল মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে দিয়েছি। তবে কোন প্রকার সোনার বারের কাগজপত্র যাচাই বাছাই করিনি। এমন কি কাস্টমসকেও জানানো হয়নি। এ ঘটনার পর চারজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জজ আদালতের পাবলিক প্রোসিকিউটর রফিক সরকার বলেন, এ ঘটনায় আইনের ব্যত্যয় রয়েছে। স্বর্ণ জব্দ থেকে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া কোনভাবেই স্বচ্ছ হয়নি। এটা দিতে হলে অবশ্যই কাস্টমস, আইনগত অথরিটি অথবা জুডিসিয়ালি ম্যাজিস্ট্রেট বা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দিতে হবে। এভাবে ফেরত দেওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না।

এ ব্যাপারে রাজশাহী বিভাগের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে রিপোর্ট আসলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *