
|| বাপি সাহা | উন্নয়নকর্মী ||
মৃত্যু একটি চরম সত্য। জন্মের স্বাদ গ্রহণ করলে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহন করতে হবে। মৃত্যুর কোন বয়স নেই, দিন নেই। মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। উপকূলীয় বিভাগীয় শহরে সাংবাদিক মামুন রেজার মৃত্যু এই শহরের অনেককে কাঁদিয়েছে। স্মার্টভাবেই এই শহরের রাজপথে হেটে চলেছেন। বয়স মাত্র ৪৫।স্বাভাবিক মৃত্যুর বয়স নেই। কিন্তু এটা সত্য, মৃত্যু যে কোনো বয়সে হতে পারে। কিন্তু অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়াটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। মামুন রেজা ছেড়ে চলে গেলেন ২০ জুন রাত ৯ টায়। তাঁর এই চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন।
মামুন রেজা ছাত্র জীবনে সাংবাদিকতা শুরু করেন। লেখাটার মাঝখানে একটু বলে রাখি, আমরা যারা ছোট এবং অবহেলিত শহরে বসবাস করি তারা ভাল কাজ করলেও অনেকটা অবহেলার স্বীকার হয়েই থাকি। প্রাপ্তির স্থানটি অনেকটা হতাশাজনক। এই অঞ্চলে অনেক প্রতিভার অবস্থান থাকলেও কতটুকু মুল্যায়ন হয়েছে, সেটির প্রশ্ন রাখতে চাই সকলের কাছে। মামুন রেজা ছাত্র জীবনে সাংবাদিকতা পেশাটি বেছে নেন। পেশাটি অনেক সহজ মনে হলেও কাজটি কিন্তু সহজ নয়। মামুন রেজা নিজের চেষ্টায় অনেক কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন ধৈর্য্যশীল একজন মানুষ। নিজের দায়িত্বের প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল। নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে বেশী আগ্রহী ছিলেন। খুলনার অবহেলিত অঞ্চলের মানুষের কথা উপস্থাপন করেছেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। কয়রা , দাকোপসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কষ্ট বাঁধ ভাঙ্গন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে প্রচার করেছেন। আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক জন্মভূমি দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন।
দৈনিক পূর্বাঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। আঞ্চলিক পত্রিকা থেকে জাতীয় পর্যায়ে পত্রিকার ব্যুরো চীফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অন্তরিকতার সাথে। চ্যানেল ২৪ এর খুলনার প্রধান ছিলেন তিনি। উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা তিনি উপস্থাপন করেছেন এবং বলেছেন। অন্যায়ে বিরুদ্ধে কথা বলতে তিনি পিছপা হননি কখনো। পৃথিবীর অন্যতম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন নিয়ে তিনি ভাবতেন। সেখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকার কথা উপস্থাপন করে চেষ্টা চালিয়েছেন তাদের জীবনের কিছুটা পরিবর্তন করার।
বেসরকারী উদ্যোগে ১৪ ফেব্রুয়ারী “বিশ্ব ভালবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালবাসুন’’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে পালন করা হয়ে থাকে। দিবসটির দিনক্ষণ এলেই তিনি কিন্তু নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে সুন্দরবন দিবস পালনের জন্য যাবতীয় সহযোগিতা করেছেন অকৃপণভাবে। অবহেলিত খুলনার সাংবাদিক সমাজের জন্য লড়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের শুভ উদ্যোগের প্রতি ছিল তাঁর সমর্থন। অবহেলিত খুলনার উন্নয়নের জন্য তিনি লিখেছেন, বলেছেন। জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করেছেন অবিরামভাবে। উন্নয়ন কার্যক্রমে ধীরগতি, অনিয়ম সম্পর্কে উপস্থাপন করেছেন অবিরামভাবে। মামুন রেজা নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে।
খুলনার অবস্থান উপকূলীয় অঞ্চলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে আমাদের বেড়ে উঠা। আইলা, সিডর, আম্পান, নদীভাঙ্গন এই নিয়ে আমাদের বসবাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও মামুন রেজা ছিলেন সরাসরি সম্প্রচারে।
ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, নাগরিক সমস্যা, উন্নয়নে খুলনার প্রতি বৈষম্য মামুন রেজার লেখনীতে ফুটে উঠেছে।
এই মানুষটিকে কোন সমস্যার কথা বলতে গেলে শুনতেন ধৈর্য্য সহকারে। অনেকসময় একটা মিষ্টি হেসে দিয়ে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিতেন। পেশাগত মতাদর্শের বিভাজন থাকতেই পারে; কিন্তু সহকর্মী হিসেবে সকলকে নিয়ে কাজ করার একটা আগ্রহ ছিল তার ভিতর। মামুন রেজার মৃত্যুতে কেউ কিন্তু বসে থাকতে পারেননি। ছুটে এসেছেন নীরবে অশ্রু ছড়িয়েছেন।
স্বল্প বৃষ্টিতে খুলনার রাজপথের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে সেটি উপস্থাপন করেছেন আঞ্চলিক ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমে। আইন শৃঙ্খলার অবনতির ফলে খুলনার মানুষের নিরাপত্তার কথা উপস্থাপন করেছেন মামুন রেজা। রাজপথে মানবন্ধনে নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে তিনি পিছপা হননি। সহকর্মীদের পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন সহযোদ্ধার মত। মৃত শিল্পাঞ্চলের জন্য নিজে যুদ্ধ করেছেন জীবিত করার জন্য।
মিডিয়াকর্মীরা রাতদিন ছুটে বেড়ান খবরের জন্য। রাজপথ যখন রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে, মামুন রেজা তখন চ্যানেল ২৪ এর সরাসরি সম্প্রচারে। টানা ছত্রিশ ঘন্টা কাজ করেছেন বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য। সেই নজির স্থাপন করে গেছেন মামুন রেজা। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ফেসবুকের পাতায় লিখেছিলেন, “মতাদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সহকর্মী মামুন রেজা, মামুন রেজাই।
একটি কাকতলীয় ঘটনাঃ
একটি কাকতলীয় ঘটনার নায়ক হয়ে তিনি থাকবেন সেটি হচ্ছে, তিনি তাঁর মায়ের কোলে এসেছিলেন ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে আর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান ২০ জুন ২০২৫। তারিখটি কিন্তু এক হয়ে রয়েছে শুধুমাত্র সাল এবং মাসের পরিবর্তন।
খুলনা প্রেসক্লাবের চারবারের সাধারণ সম্পাদক, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) দুইবারের সভাপতি। কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে, তার শুরু দৈনিক জনবার্তা দিয়ে, দৈনিক জন্মভূমি, সান্ধ্যকালীন দৈনিক রাজপথের দাবী, সর্বশেষ দৈনিক সমকাল, চ্যানেল ২৪ এবং দৈনিক পূর্বাঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধি।
দল বা মতের কট্টর মানুষ হওয়ার চেয়ে একজন ভালো মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল মানুষটির মধ্যে। অনেক কঠিন কথার উত্তর দিতেন মুচকি হেসে। রসিকতা ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ। কিন্তু কাউকে আঘাত করতেন না।
মানুষ চলে য়ায় কিন্তু আনেক স্মৃতি রেখে যায। ক্ষণজন্মা মানুষটি চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন শিশুপুত্র জাওয়াদ ও পরিবারের সদস্যদের, তাদের জন্য আমাদের দায়িত্ব অনেক। পিতার নিথর দেহের পাশে অবুঝ শিশু যখন জানাযার জন্য অপেক্ষা করে, সেই দৃশ্য অনেক ভারী।
লেখাটির শেষে সকলের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে অনুরোধ থাকবে শোকসভা, স্মৃতিচারণ সভা অনেক হবে; কিন্তু মামুন রেজার পরিবার যেন ভালো থাকে, সেজন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আমি খুব মুল্যবান মানুষ নই; তবে বলতে চাই, খুলনার অনেক সাংবাদিক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন; কিন্তু অনেকের পরিবার ভালো নেই। মানুষের কথা যারা বলে তাঁরা যেন ভালো থাকে।
মামুন রেজার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: বাপি সাহা, উন্নয়নকর্মী, খুলনা। মোবাইল- ০১৮৩০-১৯৮৫৫০, ইমেইল- sahabapi998@ gmail.com