|| মো. ওমর ফারুক ||
বাংলাদেশ-সহ ভারতীয় উপমহাদেশে শীতকালে ইসলামী মাহফিলের চর্চা বহুদিনের। ইসলাম চর্চা ও এর দাওয়াতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত এ ধরনের অনুষ্ঠানাদি এই অঞ্চলে ইসলামি সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এর উদ্দেশ্য কতটুকু মানবসমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটি উপলব্ধির বিষয়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর অপার মহিমায় আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ সৃষ্টি করে খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে এই নশ্বর দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করবো।” (আল-কুরআন, সুরা বাকারা : ৩০)।
মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কতিপয় দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে তারা তাদের একমাত্র প্রভুর ইবাদত-বন্দেগী করবে, এটিই স্বাভাবিক। আল্লাহ জাল্লা শা’নুহু বলেন, “আমি জ্বিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (আল-কুরআন, সুরা আল-যারিয়াত : ৫৬)।
আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে বান্দার সমস্ত কর্মই ইবাদত হিসেবে গণ্য। পক্ষান্তরে, তাঁর নির্দেশিত পন্থার বাইরে গিয়ে বান্দা তার নিজ দৃষ্টিতে যত ভালো কাজই করুক না কেন, তা তাঁর নিকট ইবাদত হিসেবে গ্রহণীয় হবে না। তাই আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধগুলি তাঁর বান্দার নিকট তুলে ধরে সঠিক পথের সন্ধান দিতে যুগে যুগে নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবি-রাসূলগণ মানুষদেরকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন, কল্যাণের দিকে আহ্বান করেছেন, ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝিয়ে সঠিক পথে চলতে শিখিয়েছেন। আল্লাহ পাক আরো বলেন, “বলুন! এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে ডাকি। আল্লাহ মহাপবিত্র আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই” (আল-কুরআন, সুরা ইউসুফ : ১০৮)।
এরই ধারাবাহিকতায় সত্যের দিশা দিতে সর্বশেষ নবি ও রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, “হে নবি! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে’। ‘আল্লাহর অনুমতিতে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।” (আল-কুরআন, সুরা আহযাব : ৪৫-৪৬)।
নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষকে হেদায়েতের পথে, আলোর পথে, মানব-মানবতার কল্যাণের পথে, সত্য ও সুন্দরের পথে সর্বোপরি আল্লাহর পথে আহ্বানের তাঁদের সেই গুরুদায়িত্ব পালনের ভার অর্পিত হয়েছে ওলামা-পির-মাশায়েখদের উপর। কেননা, হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আলিমগণই নবিগণের উত্তরাধিকারী।’ [আল-হাদিস, মিশকাত শরিফ]।
রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদতের দিকে আহ্বানের জন্য মানুষদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘ইবনু আব্বাস রা. বলেন, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মু‘আয রা.-কে ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। সুতরাং তাদেরকে প্রথম আহ্বান করবে, তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার একত্বকে মেনে নেয়। যদি তারা তা স্বীকার করে তবে তাদেরকে বলবে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে ফরয করেছেন। তারা যদি নামায আদায় করে তবে তাদেরকে জানাবে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনীদের নিকট থেকে আদায় করা হবে এবং গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। তারা যদি এটা মেনে নেয়, তাহলে তাদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে। তবে মানুষের সম্পদের মূল্যের ব্যাপারে সাবধান থাকবে [আল-হাদিস, বুখারি শরিফ]।
মানুষের জীবন-মরণ, ধন-দৌলত ও আশা-প্রত্যাশার মালিক ও প্রভু সমগ্র জগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআলা। যিনি তাঁর মহব্বতের সৃষ্টিকে সূর্যের আলো ও তাপ, চন্দ্রের কিরণ, বাতাসের অক্সিজেন, পানির পবিত্রতা ও স্বচ্ছতা এবং হাজারো রং ও স্বাদের রিযিক দিয়ে প্রতিপালন করছেন। সেই মালিকের এতসব নেয়ামত পাওয়ার পরও মানুষ তাঁকে ভুলে গিয়ে ধীরে ধীরে গোমড়াহীর দিকে পা বাড়ায়। তাই, যুগ যুগ ধরে নবুওয়াতি ধারার দাওয়াতি মিশন হিসেবে ওলামা-মাশায়েখ ও আওলিয়া কেরাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এই গোমড়াহীর পথ থেকে মহাসত্য ও মহাসুন্দরের দিকে ফিরিয়ে আনতে মানুষদেরকে নিরলসভাবে আহ্বান করে চলেছেন।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দাওয়াতি কার্যক্রমের মহোৎসব চলে শীতকালে। এসময় ইসলামি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন পাড়ায়-মহল্লায় ওয়াজ মাহ্ফিল, তাফসিরুল কুরআন মাহ্ফিল, ইসলামি জলসা, আজিমুস্শান জলসা, ইসালে সওয়াবসহ বিভিন্ন নামে ইসলামি দাওয়াতের মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক এই মাহ্ফিলগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এগুলো প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। এর থেকে মানুষ হেদায়েতের আলোর সেই দিশা সঠিকভাবে পাচ্ছে কিনা তা এখন সন্ধিহান। যুগের এই মাহ্ফিলগুলোকে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন বলে অনেকে মনে করেন। কেননা, উঠতি বয়সি কিছু তরুণ বক্তাদের মুখে শোনা যায়, এবার ‘ওয়াজ ব্যবসা’ ভালো/মন্দ যাচ্ছে। আবার এই মাহ্ফিলকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অর্থ কালেকশনের মহড়া চলছে। অন্যদিকে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা মাহ্ফিলের মঞ্চে আসন ও পোস্টারে নামের মাধ্যমে পরিচিতি লাভের উপায় খুঁজছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাওয়াতি এ মাহ্ফিলগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে।
বর্তমানে অধিকাংশ ইসলামি মাহ্ফিলগুলোর করুণ পরিণতির কারণ হচ্ছে, আমরা পার্থিব লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা-বিশ্বাস থেকে দূরে চলে যাচ্ছি এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদর্শমানব, নবি ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ ও জীবনাচরণ অনুসরণ ও অনুকরণ প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। আমরা দেশকে ও দেশের মানুষকে হৃদয় দিয়ে পূর্ণভাবে ভালোবাসতে পারছিনা। হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতায় আমাদের অন্তর কলুষিত। এ অনৈতিক ও আদর্শহীন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ধর্মীয় সভা ও মাহ্ফিলগুলোতে উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনা, পরচর্চা, পরনিন্দা ও নেতিবাচক বক্তব্য কমিয়ে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত ও মানব সেবার ওয়াজ নসিহত বৃদ্ধি করতে হবে। কেননা, পবিত্র কুরআনে এসেছে, “আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে হেকমত ও উপদেশ দ্বারা আহবান করুন এবং তাদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক করুন। তাঁর পথ থেকে কে পথভ্রষ্ট হয়, সে ব্যাপারে আপনার প্রতিপালক অধিক জ্ঞাত এবং কে হেদায়াতপ্রাপ্ত তাও তিনি সবিশেষ অবহিত।” (আল-কুরআন, সুরা নাহল : ১২৫)।
কুরআন-হাদিসের অতি মূল্যবান আলোচনার মাঝে কালেকশন ও সাধারণ সভা-সমিতির মতো সামাজিক ব্যক্তিবর্গের দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা-বিবৃতির ব্যবস্থা, ধর্মীয় সভার সাথে এক ধরনের অশোভনীয় ও অসহনীয় আচরণ হিসেবে গণ্য। তাই ধর্মীয় মাহ্ফিল শুরুর পূর্বেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা এবং মাহ্ফিলস্থল কালেকশন মুক্ত রেখে কেবলমাত্র ধর্মীয় আলেমগণের বক্তব্য ও ওয়াজ নসিহত শোনার আয়োজন করা। এর মাধ্যমে শত্রুতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ-লালসা, চিন্তার সংকীর্ণতা ও সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা দূর করা এবং আত্মার উন্নতি সাধন করে পরকালের সেই চরম সফলতা অর্জন করা। মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করল সে-ই সফল, আর ব্যর্থ সে-ই যে নিজের অন্তঃকরণকে কলুষিত করল।” (আল-কুরআন, সুরা আশ্ শামস : ৯-১০)।
আত্মিক উন্নতি ও ত্যাগ এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে ভালোবাসার মধ্যেই মানুষ সৃষ্টির মহান উদ্দেশ্য নিহিত। আমাদেরকে একদিকে যেমন আল্লাহ্ পাকের ইবাদতে রত থাকতে হবে। অন্যদিকে তাঁর গুণাবলি ধারণ করে রাসূলে পাকের সুমহান চরিত্র অনুসরণ করতে হবে।
অতএব আসুন, ইসলামের সুমহান আদর্শে আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শান্তিপ্রিয় করে গড়ে তোলার জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে এ ধরনের ধর্মীয় সভার আয়োজন করি ও অংশগ্রহণ করি এবং বিশিষ্ট আলেমগণের অতি মূল্যবান আলোচনা শুনে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ সাধনে একে অন্যকে সহযোগিতা করি। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে হেদায়েত নসিব করুন এবং রাসূলে পাকের খাঁটি উম্মত হওয়ার তৌফিক দান করুন। (আমিন)।
লেখক: এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), কুষ্টিয়া।