
|| আব্দুর রহিম | নিজস্ব প্রতিবেদক ||
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষায় মূল মার্কশিট যাচাই-বাছাই না করায় পার পেয়ে যাচ্ছেন আরবি প্রভাষক পদের হাজারো ভাইভা প্রার্থী। যাদের অনেকেই অসত্য তথ্য দিয়ে আবেদন করেছেন।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (NTRCA) ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এই লক্ষ্যে, যাতে দেশে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া আরও মানসম্পন্ন এবং স্বচ্ছ হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি কিছু বিষয় ছাড়া অধিকাংশ বিষয়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পেরেছেন বলে অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন। তবে স্বচ্ছতার বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ প্রদান করতে পেরেছেন সেই ব্যাপারে তারা একমত নয়।
বিসিএসের আদলে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা থেকে তিন ধাপে (প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা) শুরু হয়। তবে মৌখিক পরীক্ষার ২০ মার্ক মেধা তালিকা তৈরিতে যুক্ত হয় না। মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রার্থীর অ্যাকাডেমিক সনদ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা। যাতে কোনো প্রার্থী অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে নিয়োগ না পেয়ে যান। যা মৌখিক পরীক্ষা চালুর পূর্বে ঘটেছিলো। তখন এনটিআরসিএ শুধুমাত্র পরীক্ষা নিয়ে সনদ প্রদান করতেন। কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হতো।পরবর্তীতে যোগ্য প্রার্থী ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নীতিমালা পরিবর্তন করে নিয়োগ সুপারিশ ও মৌখিক পরীক্ষা চালু করেন। যাতে আর কেউ অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে না পারেন।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সেই এনটিআরসিএ অফিসে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় মার্কশিট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে যারা ১৮তম সহকারী মৌলভী পদে ভাইভা দিয়েছেন তারা বলেন, আমরা দেখেছি বিগত সহকারী মৌলভী পদের মৌখিক পরীক্ষার সময় ফাযিলের মার্কশিট যাচাই করা হয়নি। শুধুমাত্র তিনটা সনদ (দাখিল, আলিম ও ফাযিল) যাচাই করা হয়েছে অথচ ফাযিল অথবা অনার্সের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে অনেকেই অনুমান করে রেজাল্ট বসিয়ে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। ১৮তম সার্কুলার এবং এনটিআরসিএ কর্তৃক টেলিটকের মাধ্যমে ভাইভার জন্য পাঠানো ম্যাসেজে সকল অ্যাকাডেমিক সনদ ও মার্কশিট নিয়ে যেতে বলা হয়েছিলো।
যেহেতু ভাইভার মার্কযুক্ত হচ্ছে না তাই মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রার্থীর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা। যদি সেই কাগজপত্রই ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা না হয়, তাহলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার কী প্রয়োজন রয়েছে?
নিয়োগ সুপারিশের পর এমপিও আবেদনের সময়ও সকল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা লাগে আবেদন ফর্মে। কিন্তু কোনো ভুল তথ্য প্রদান করলে সেটা উপজেলায় ধরা হয় না। কারণ, সেখানে ঘুষ বাণিজ্য চলছে। তাই অনেকে প্রার্থী নিয়োগ সুপারিশের সাথে সাথে অটো এমপিও চালু করার দাবি জানিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও নিয়োগপত্র প্রদানের পূর্বে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সনদ যাচাই-বাছাই ছাড়াই নিয়োগপত্র প্রদান করে থাকেন। তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন, এনটিআরসিএ নিয়োগ সুপারিশ করেছেন তাই দুর্নীতির সুযোগ নেই। আমরা আর কী যাচাই-বাছাই করবো?
মৌখিক পরীক্ষার সময় এনটিআরসিএ-এর কর্মকর্তারাও কাজের চাপে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে থাকেন। তাদের মূল দায়িত্ব হলো সকল অ্যাকাডেমিক সনদ, আবেদন কপি, মার্কশিট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করা। কিন্তু সমস্যা হলো বেশিরভাগ কর্মকর্তা হলেন জেনারেল শিক্ষিত। তাই তারা মাদ্রাসা নীতিমালা ও মাদ্রাসা সম্পর্কে ততো ভালো জানেন না। এই ক্ষেত্রে অনেক প্রার্থী দাবি করেন মাদ্রাসার মৌখিক পরীক্ষার সময় মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে যেন রাখা হয়।
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রভাষক (আরবি) পদে অনেকেই কামিল ও মাস্টার্সের মনগড়া অথবা অনুমান করে একটা ফলাফল বসিয়ে অনৈতিক বা অবৈধভাবে আবেদন করেছেন। ১৮-তম শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদনের মেয়াদ ৩০ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ রাত ১২:০০টায় শেষ হয়। এই তারিখের পর যাদের কামিল ও মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশিত হয় তারা ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদন করার জন্য অযোগ্য। এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সার্কুলারে বলা হয়েছে যে, কোনো অবতীর্ণ প্রার্থী [Appeared সার্টিফিকেট) গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা জানি, বিসিএস ছাড়া আর কোনো চাকরির ক্ষেত্রে অবতীর্ণ প্রার্থী গ্রহণযোগ্য নয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) এমপিও নীতিমালায় প্রভাষক (আরবিসহ অন্যান্য বিষয়ে) ৪বছর মেয়াদী অনার্সসহ মাস্টার্স অথবা ফাযিল ডিগ্রিসহ কামিল বলা আছে।তবুও অনেকেই এইসব তথ্য জেনেও ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদন করেছেন। যা আইন লঙ্ঘন ও দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রার্থীরা নিম্নোক্ত দাবি করেন :
১. ১৮তম মৌখিক পরীক্ষায় কাগজপত্র (আবেদন কপি, সকল অ্যাকাডেমিক সনদ ও মার্কশিট বা টেবুলেশন সিট) যাচাই-বাছাই করতে হবে। কারণ মার্কশিটে ফলাফল প্রকাশের তারিখ উল্লেখ থাকে।
২. যারা অপরাধী তাদের প্রার্থীতা বাতিল করে আজীবনের জন্য আর যেনো এনটিআরসিএ-তে আবেদন করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে অধিকাংশ প্রার্থীই সার্কুলার ভালোভাবে না পড়ে আবেদন করেন। কারণ সার্কুলারে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে এইভাবে বলা আছে।
ধারা ৬(অবতীর্ণ প্রার্থী) এর(ক) তে বলা আছে শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে পরীক্ষায় অবতীর্ণ (Appeared) কোন প্রার্থীর আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না।
ধারা ৮(ডিক্লারেশন) এর (ক) তে বলা আছে প্রার্থীকে অনলাইন আবেদনপত্রের ডিক্লারেশন অংশে এ মর্মে ঘোষণা দিতে হবে যে, আবেদনপত্রের প্রদত্ত সকল তথ্য সঠিক এবং সত্য। প্রদত্ত তথ্য অসত্য বা মিথ্যা প্রমাণিত হলে অথবা অযোগ্যতা ধরা পড়লে বা কোনো দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হলে বা কোনো প্রার্থী মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে বা কোনো অংশ বা প্রবেশপত্র কাটাকাটি বা জাল সার্টিফিকেট দাখিল করলে বা প্রতারণার আশ্রয় নিলে তাকে উক্ত পরীক্ষাসহ NTRCA কর্তৃক অনুষ্ঠেয় পরবর্তী যে কোনো পরীক্ষার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হবে, অধিকন্তু তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যক্রমও গ্রহণ করার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে।
ধারা ১৯ (বিবিধ) এর (ঘ)তে বলা আছে- লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে প্রার্থীকে অনলাইন আবেদনপত্রে প্রদত্ত প্রতিটি তথ্যের স্বপক্ষে যথাযথ সনদ/প্রত্যয়নপত্র মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকালীন বোর্ডের সম্মুখে প্রদর্শন করতে হবে। কোনো প্রার্থী অনলাইন আবেদন ফরম-এ প্রদত্ত তথ্য ও শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমানস্বরূপ যথাযথ সনদ/প্রত্যয়নপত্র বোর্ডের সম্মুখে দাখিল করতে ব্যর্থ হলে বা কোনো পদের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে বা আবেদন ফরমে ভুল তথ্য প্রদান করলে বা কোনো অযোগ্যতা বা কোনো Substantive ত্রুটি ধরা পড়লে যে কোনো পর্যায়ে তার প্রার্থীতা বাতিল বলে গণ্য হবে।
(ঙ)যদি কোনো প্রার্থী অসত্য /ভিন্নরূপ/ভুল তথ্য প্রদান করেন এবং যে কোনো পর্যায়ে তা প্রমাণিত হয় তবে তার সামগ্রিক প্রার্থীতা বাতিলা হবে এবং তিনি NTRCA কর্তৃক গৃহীতব্য পরীক্ষায় সকল পদে আবেদনের অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং উক্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
এর আগে, ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় একইভাবে অসত্য তথ্য দিয়ে অবেদন করে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেছেন বলে অনেকে দাবি করে আসছেন।
কাজেই এনটিআরসিএ-এর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে এবং দুর্নীতি রোধে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার আরবি প্রভাষক পদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণকালে সকল অ্যাকাডেমিক সনদের সাথে আবেদন কপি এবং কামিল ও মাস্টার্সের মার্কশিট যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নতুবা অনেক প্রার্থী অসদুপায় অবলম্বন করার পরেও পার পেয়ে যাবেন।
শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ যেন দিন দিন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে।
তারা মার্কশীট যাচাই করেনা তারমানে তারা যোগ্য প্রার্থী খুজে না বরং চেহারা খোজে।
স্পষ্ট ভাষায় দ্যার্থ কণ্ঠে জানাই, আরবি প্রভাষক পদে যারা ভাইভা দিবে এদের ক্ষেত্রে যদি মার্কশীট ও অন্যান্য তথ্যাদি যাচাই না করা হয় এবং যাচ্ছেতাই ভাবে ফলাফল প্রকাশিত হয় তাহলে কঠোর আন্দোলন চলবে।