
|| শেখ শাহরিয়ার ||
বাউল সম্রাট লালন (১৭৭৪-১৭ অক্টোবর ১৮৯০) ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামেও পরিচিত। বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম এই সাধক অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। উনিশ শতকের বাংলা সমাজে তাঁর গান ও দর্শন এক বিপ্লব এনেছিল।
বাংলা সংস্কৃতি ও মানবতার চেতনায় লালন আজও অমর। তিনি সমাজের ভেদাভেদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও জাতপাতের উর্দ্ধে উঠে মানুষকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে দেখেছিলেন। লালনের ভাষায়—
“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।”
এই পংক্তিতেই প্রকাশ পায় তাঁর গভীর মানবতাবাদী চিন্তাধারা যেখানে মানুষকে বিচার করা হয় না ধর্ম, বর্ণ বা জাত দিয়ে, বরং মানবতার মানদণ্ডে। ফকির লালনের ভাবদর্শন ছিল সমাজে সাম্য, ভালোবাসা ও সহিষ্ণুতার বার্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ তার আত্মার ভেতরেই খুঁজে পাবে সত্য ও মুক্তি। তাঁর গানগুলো এখনো সমাজকে প্রশ্ন করে কেন মানুষের মাঝে ভেদাভেদ টিকে আছে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে।
লালন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের সব দেয়াল ভেঙে মানুষকেই সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর গানে ফুটে ওঠে আধ্যাত্মবাদ, মানবতাবাদ এবং আত্মজিজ্ঞাসা। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউরিয়ায় একটি আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন, যেখানে তিনি শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁকে ভালোবেসে ‘সাঁই’ বলে সম্বোধন করতেন।
প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে ছেঁউরিয়ায় আয়োজিত হয় তিন দিনব্যাপী “লালন স্মরণোৎসব”। দেশ-বিদেশের হাজারো সাধক, বাউল ও গবেষক সেখানে মিলিত হন। হয় আখড়াবাড়ির মিলনমেলা, লালনগীতি পরিবেশনা, আলোচনা সভা ও দর্শনচর্চা।
আজকের বিভক্ত ও ভোগবাদী সমাজে লালনের দর্শন আগের চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি যে “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” দর্শন শিখিয়েছিলেন, তা আজও মনে করিয়ে দেয় প্রকৃত ধর্ম হলো মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহনশীলতা ও সাম্যের চর্চা। ফকির লালন ছিলেন শুধু একজন গীতিকবি নন, তিনি ছিলেন বাংলার আত্মার কণ্ঠস্বর। তাঁর তিরোধান দিবসে তাই প্রশ্ন জাগে আমরা কি সত্যিই তাঁর শেখানো “মানুষের ধর্ম” বুঝতে পেরেছি?
লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী। মেইলঃshariernews@gmail.com মোবাইলঃ ০১৭১১-৩০৫৩৬৪