বুধবার, জানুয়ারি ১৫

মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত রচনায় সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষা

﴿أَفَمَن شَرَحَ ٱللَّهُ صَدۡرَهُۥ لِلۡإِسۡلَٰمِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٖ مِّن رَّبِّهِۦۚ فَوَيۡلٞ لِّلۡقَٰسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ فِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٢٢﴾

‘আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং যে তার প্রতিপালক প্রদত্ত আলোতে রয়েছে সে কি তার সমান যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ সেই কঠিন হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য যারা আল্লাহর স্মরণ হতে বিমুখ হয়।’ –(সূরা যুমার, আয়াত-২২)

ইসলামী গবেষণা পরিভাষাটি শুনতে নতুন ও আধুনিক মনে হলেও এটি ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সারনি। কুরআন মজিদের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ পাক চিন্তা অনুধ্যান ও গবেষণার তাকিদ দিয়েছেন এবং চিন্তাশীল ও গবেষক বান্দাদের প্রশংসা করেছেন। যেমন বলা হয়েছে:
قَدۡ فَصَّلۡنَا ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَفۡقَهُونَ
‘আমি তো অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি। -(সূরা আনআম, ৯৮) فَلَا تَتَفَكَّرُون ‘তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না।’ -( সূরা আনআম, ৫০) أَفَلَا يَعۡقِلُونَ ‘তোমরা কি অনুধাবন কর না।-(সূরা ইয়াসীন ৬৮) َٱعۡتَبِرُواْ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَبۡصَٰرِগূরাহাশর আয়াত-২ অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।–(সূরা হাশর-২) َيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ‘আর তারা আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে।’-(সূরা আলে ইমরান, ১৯১)

কুরআন মজীদের এসব বাচনভঙ্গি সামনে রাখলে মনে হবে কেবল চিন্তাশীল লোকদের জন্যই আল্লাহ পাক কুরআন মজীদ নাযিল করেছেন। কুরআনের এই আবেদনে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্বেকার মুসলিম মনীষী গবেষকগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণার সৌধমালা গড়ে তুলেছেন, ফিকাহসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেছেন এবং কুরআন, হাদীস ও ইসলামী জ্ঞানভান্ডারের ধারাবাহিকতা আমাদের পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের শ্রম, সাধনা ও গবেষণাকে মূল্যহীন করার জন্য বর্তমান সময়ে এক কুচক্রি মহল উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের ভয়াবহ বক্তব্য হলো, কুরআন হাদীসের বাইরে আর কিছু চর্চা করা যাবে না।

অন্যদিকে কুরআন ও হাদীসকে আমরা শুধু তেলাওয়াত ও খতমে বুখারির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সামনে মাহে রমজান আসছে। রমযানে তারাবীহ নামাযসহ সর্বত্র কুরআন তেলাওয়াতের একটি বেহেশতি পরিবেশ বিরাজমান থাকে। কিন্তু সবাই এ কথা স্বীকার করবেন যে, কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণকে আমরা যতখানি গুরুত্ব দেই সেই তুলনায় কুরআন বুঝে পড়া, গবেষণা, অধ্যয়ন করা এবং কুরআন মজীদ থেকে যুগজিজ্ঞাসার সমাধান বের করার বিষয়টিকে সামান্যতম গুরুত্বও আমরা দেই না।

শীতের মওসুমে সারা দেশে শহরে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদুন্নবী, সিরাতুন্নবী, ইজতেমা, জোড়, তাফসীর মাহফিলের মতো গণমুখি ইসলামী অনুষ্ঠানগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাজে ইসলামী বক্তাদেরও যথেষ্ট সমাদর আছে। সেই তুলনায় একজন লেখক, গবেষককে আমরা যথার্থ সম্মান দেই না। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে লেখা বইগুলোর কদর আমাদের মাঝে বলতে গেলে একেবারেই নেই। বই পড়ার মানসিকতাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এর জন্যে আমাদের চিন্তার দৈন্যতা ও কুরআনের বাণী অনুধাবনে আমাদের অনীহাকেই দায়ী করতে হবে।

ইহুদী খ্রিস্টান পন্ডিতরা আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় বসে কুরআন নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে যেসব মূল্যায়ন পেশ করেন সেগুলোই আমাদের ইসলামী চিন্তাবিদরা গলাদকরণ করে গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন। ফলে তারা না সমাজকে সঠিক পথ দেখাতে পারছেন, আর না সমাজ তাদেরকে বিশ্বাস ও বরণ করে নিতে পারছে।

চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যতার একটি কারণ, আমরা কুরআন মজীদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক আবেদনকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবি বা চিন্তাবিদরা কেবল জাগতিক বিষয় নিয়ে মহাব্যস্ত। আর যারা নিজেদেরকে ধর্মের অথরিটি মনে করি তারা জাগতিক বিষয়-আশয় ছেড়ে শরীয়ত কিংবা মারফত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা হলো, আমাদেরকে অন্তর্জগত ও বহির্জগত উভয়ের মাঝ থেকে আল্লাহর নিদর্শন আবিষ্কার করতে হবে।

﴿سَنُرِيهِمۡ ءَايَٰتِنَا فِي ٱلۡأٓفَاقِ وَفِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّۗ أَوَلَمۡ يَكۡفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُۥ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ شَهِيدٌ٥٣﴾

‘আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাবো বিশ্বচরাচরে ও তাদের নিজেদের অভ্যন্তরে, ফলে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তিনিই পরম সত্য। তোমার পরিচালক সম্পর্কে এটুকুই কি যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত।’ -(সূরা হা-মীম-আস সাজদা, আয়াত-৫৩)

কুরআন মজীদের একটি অসাধারণ পরিভাষা এই ‘আয়াত’। আয়াত অর্থ নিদর্শন। এই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সৃষ্টি জগতের পরতে পরতে, আবার মানব সত্তার অভ্যন্তরে। এই নিদর্শন আবিষ্কার ও অনুধাবন করতে হলে বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় প্রশাখায় আমাদেরকে বিচরণ করতে হবে।

বিষয়টি আমরা এভাবেও বুঝতে পারি। আলেম সমাজের পরিচয় দিতে গিয়ে আমরা কুরআন মজীদের একটি আয়াতের শেষাংশ উদ্ধৃত করে দাবি করি ‘নিশ্চয়ই আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করেন।’ প্রশ্ন করি, এই আলেম কারা। সম্পূর্ণ আয়াতটি সামনে রাখলে আমরা এর জবাব পাব।

﴿أَلَمۡ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجۡنَا بِهِۦ ثَمَرَٰتٖ مُّخۡتَلِفًا أَلۡوَٰنُهَاۚ وَمِنَ ٱلۡجِبَالِ جُدَدُۢ بِيضٞ وَحُمۡرٞ مُّخۡتَلِفٌ أَلۡوَٰنُهَا وَغَرَابِيبُ سُودٞ ٢٧ وَمِنَ ٱلنَّاسِ وَٱلدَّوَآبِّ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ مُخۡتَلِفٌ أَلۡوَٰنُهُۥ كَذَٰلِكَۗ إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ٢٨﴾

‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টিপাত করেন; এবং আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে আছে বিচিত্র বর্ণের পথ-শুভ্র, লাল ও নিকষ কাল।

এভাবে রং বেরং এর মানুষ, জন্তু ও গবাদি পশু রয়েছে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’
-(সূরা ফাতির-২৭-২৮)

লক্ষ্য করুন, আল্লাহ পাক নৃবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, সৌরবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত, ভূতত্ত্ব, কৃষি, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতি অর্থাৎ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধিত সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত করার পর বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেম (জ্ঞানী ব্যক্তি)-রাই আল্লাহকে ভয় করে।’ পরের আয়াতে এসব জ্ঞানী ব্যক্তির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, আল্লাহর সঠিক পরিচয় লাভে ঋদ্ধ এসব জ্ঞানীর জীবন ও জবান দিয়ে আল্লাহর যিকির ও স্মরণ উদ্ভাসিত হবে।

আল্লাহ তাআলা গোটা সৃষ্টিলোকে দুইভাবে তার নিদর্শন ছড়িয়ে রেখেছেন। একটি আলমে খিলকত সৃষ্টিলোক , অর্থাৎ সৃষ্টিরাজির পরতে পরতে। আরেকটি কুরআন হাদীসের বাণিতে শরীয়া চর্চায়। ভাগ্যের পরিহাস যে, আমরা শরীয়ার জ্ঞানকে নিজস্ব ইসলামী জ্ঞান বলে দাবি করছি। আর সৃষ্টিলোক সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চাকে আল্লাহর দুশমনদের হাতে তুলে দেয়ার মধ্যে আখেরাতের মুক্তি ও সওয়াব সন্ধান করছি।

পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো কুরআন হাদীস নির্ভর জ্ঞানগবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের সবকিছুকে আল্লাহর ইচ্ছা মাফিক ভোগ ও ব্যবহার করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাকে একমাত্র ইসলামী শিক্ষা বলে গর্ব করা এবং স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চাকে বিজাতীয় জ্ঞান বলে অবজ্ঞা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। এ ধরনের চিন্তার কারণে সবসময় মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের কথা বলা হয়। অথচ সাধারণ শিক্ষার সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামী বিষয়াদি অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়। আমাদের চিন্তার এই সংকীর্ণতার সুযোগে তথাকথিত প্রাচ্যবিদরা আজ কুরআন-হাদীস চর্চায় অনেক এগিয়ে এবং তাদেরই চিন্তায় আক্রান্ত আহলে কুরআন জাতীয় নানা নামের গোষ্টি সৃষ্টি করে আমাদের যুব সমাজে বিশেষ করে ধনী দরবেশদের মাঝে ফিতনার মহামারি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

এই পরিস্থিতিতে বাস্তবতার দাবি হচ্ছে আমাদের মধ্যে এমন এক সর্বজনীন জাগরণ আসতে হবে, যার মাধ্যমে কুরআন ও হাদীসের উপর ইসলামের শত্রুদের কুশলী আগ্রাসনের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরা যায়। দেশে অনেকে এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, তবে গবেষণাগারের মাধ্যমে সবার মতামতকে সমন্বিত ও সংগঠিত করা নেহাত প্রয়োজন।

এই চেতনা থেকেই বায়তুশ শরফের মরহুম পীর ছাহেব ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মওলানা আবদুল জব্বার (র) আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফে ইসলামী গবেষণা ইনিস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর ড. আবদুল করিম, ড. মুঈন উদ্দীন আহমদ খানের মতো মনীষীরা এই গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের পরিচালকের পদ অলংকৃত করেছেন। বয়সে নবীন হলেও আমি ইরান যাওয়ার পূর্বে ১৯৮১ ও ৮২ সালে মরহুম পীর ছাহেব হুজুরের ¯স্নেহছায়ায় উক্ত গবেষণা ইনিস্টিটিউট এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি। তিনি ছিলেন একজন পীর ও আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকবেন, এটিই ছিল কথা। কিন্তু না। তিনি উক্ত গবেষণা কেন্দ্রের ছত্র-ছায়ায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষে আদর্শ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠার মতো জাতিগঠণমূলক পদক্ষেপে উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *