
|| বাপি সাহা ||
মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার। মুক্তিযুদ্ধকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকা এবং স্বপ্ন দেখা। স্বাধীন বাংলাদেশে যখন কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অপমানিত করা হয় অথবা হত্যা করা হয়, তখন ভাবতে অবাক লাগে—এই জন্যই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। একটি বিরাট পদক্ষেপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীন ভূখণ্ড, আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে থাকা—এই জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা রণহুঙ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।
বিপ্লব কখনোই একদিনে হয় না। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যুগে যুগে সঞ্চারিত হয়ে একদিন বিপ্লবে পরিণত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ একদিনে সংগঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকে বঞ্চনার শিকার হতে হতে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতনের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, যা এই সংগ্রামকে আরও জোরালো করে তোলে। আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎপত্তি।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে রক্ত ঝরেছে, তাকে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছিল, সেটি কিন্তু চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। আর সেটি কি ভুলে যাওয়ার মতো?
১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামের প্রারম্ভে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল, সেটি কিন্তু এখনও ভাবিয়ে তোলে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির দিকে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটি কি একটি অপরাধ নয়?
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শেষের দিকে একটি কাহিনি উপস্থাপন করছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডোদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয়েছিল, যার নাম ছিল “অপারেশন জ্যাকপট”। এটি ১৬ আগস্ট ১৯৭১ সালে পরিচালিত হয়। এই অপারেশনে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ও নৌযান ধ্বংস হয়। আকাশবাণী কলকাতা একটি দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে অপারেশনটি সফল হয়েছে।
এই অপারেশনের শেষ দিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, যখন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী কলকাতা এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরাট গলায় মুক্তিসেনাদের বিজয়গাথা শুনতে কার না ভালো লাগত। এম. আর. আখতার মুকুলের কৌতুকগাথার মাধ্যমে তখনকার চিত্র উপস্থাপনের আলাদা একটা চমক ছিল। মুক্তির গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপনা পেত।
মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা বাংলার মুক্তিবাহিনীকে যেভাবে সহযোগিতা করেছে, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করেছে। যে সকল ভারতীয় সৈন্য তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন আমাদের মুক্তির জন্য, আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
বিজয়ের ১০ দিন আগে, ৬ ডিসেম্বর, ভারতের লোকসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এক বক্তৃতায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তুমুল করতালির মাধ্যমে সেদিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে ভারতের তৎকালীন লোকসভার সদস্যরা। হত্যা-যজ্ঞের ইতিহাস বলে সমাপ্ত করা যাবে না, যেমন কৃতজ্ঞতার জায়গাও কিন্তু কম নয়।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকেও ছাড় দেয়নি নরঘাতকরা। তাঁদের মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কবীর চৌধুরী, জহির রায়হানদের মতো মানুষদের আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে। রক্ত ও মাংসের দুর্গন্ধে দেশের সকল স্থান কলুষিত হয়েছে। মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশকে পথ চলতে গেলে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধকে সাথে নিয়ে পথ চলতে হবে। যে লৌহমানবীর কথা না বললে হয়তো এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তিনি হচ্ছেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইন্দিরা গান্ধী ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করতে গেলে হোয়াইট হাউসে বসিয়ে রেখে যে অপমান করা হয়েছিল, তারপরও তিনি দমে যাননি। ধৈর্য ধরে তিনি কথা বলেছেন, অঙ্কের হিসাবের মতো হিসাব দিয়ে যুক্তি তুলে ধরেছেন। কথা না শুনলেও পরে বুঝতে পেরেছেন—মার্কিনিদের হিসাব যেন ভুল হয়ে গেছে।
শ্রীমতি গান্ধী নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন ঘুরে দাঁড়ানোর। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ভোজসভায় নিজে খাবারের স্বাদ না নিয়ে প্যাকেট করে দিতে বলেছিলেন। শরণার্থী শিবিরের মানুষগুলোর অনেকেই ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছে—বলেছিলেন, “এই খাবার প্রতীক হিসেবে আমি তাদের কাছে নিয়ে যাব, যারা আছে শরণার্থী শিবিরে।” শরণার্থী শিবিরে শিশুদের যেন কষ্ট না হয়, সে জন্য দুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শরণার্থী শিবিরে যেন কেউ কষ্ট না পায়, সে জন্য ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে থেকে দুঃখকে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো দানের ফসল নয়—যুদ্ধ করে পাওয়া এই দেশ। রাশিয়ার যে সহযোগিতা, সেটিও অবশ্যই মনে করতে হবে। মার্কিন প্রতিরোধের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যে অবস্থান, সেটিও মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে ফাদার রিগনের যে ভূমিকা ছিল, সেটিও আমাদের মনে রাখতে হবে। সকলের প্রয়াসেই আমাদের এই বিজয়।
মুক্তিযোদ্ধারা যেন ভালো থাকেন। যারা আমাদের মাঝে নেই, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক (খুলনা)।
