
|| বাপি সাহা ||
বাংলাদেশের তিনটি শ্রেণির কথা না বললে চলে না। এই দেশের অর্থনীতি যাদের উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে তারা হচ্ছে আমাদের দেশের কৃষক শ্রেণি। যারা মাঠে ফসল উৎপাদন করে আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে, তারা হচ্ছে আমাদের কৃষক সম্প্রদায়; কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত ও বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে সমাজের প্রতিটি পদে পদে। ফসল উৎপাদন করেও সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, যা আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। সারের জন্য আমার দেশের কৃষকের প্রাণ দিতে হয়েছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু কোনো সহানুভূতি সে ঘরে তুলতে পারেনি। কিছু লেখালেখি হয়েছে পত্রিকায় এর বেশি আর কি হয়েছে ? কৃষক যদি না বাঁচে সে কি বাঁচবে?
আমাদের দেশের একটি শ্রেণি অনেক কষ্ট করে বিদেশের মাটিতে তাদের শ্রম বিক্রি করে আমাদের উন্নয়নে অর্থ পাঠাচ্ছেন, তারা হচ্ছেন রেমিটেন্স যোদ্ধা। নিজের যে টুকু ছিল সেটুকু বিক্রি করে দেশের বাইরে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন । কতটুকু সন্মান আমারা তাদের দিতে পেরেছি, সেটি কি প্রশ্নবিদ্ধ? সরকারী কতটুকু সহযোগিতা বিদেশীর মাটিতে তারা পান? সেটি ভাবার সময় কিন্তু এখন এসেছে। বিদেশের মাটিতে হয়ত কোনো একটি রাস্তায় ঝাড়ু দিয়ে যে অর্থ উপর্জন করেন, সে অর্থ পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে স্বপ্ন দেখেন নতুন কিছু। যেখানে তারা থাকেন সেই ঘরটি কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত সেটি নিয়ে এখন কিন্তু ভাবার সময় এসেছে।
এবার যাদের কথা আমরা একটু বলার চেষ্টা করব তারা হচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্পের সাথে যারা জড়িত সেইসকল গার্মেন্টস শ্রমিকবৃন্দ। আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকবৃন্দ। তারা কতটুকু ভাল আছেন, সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি? হঠাৎ করে আমাদের এই গার্মেন্টস শিল্পের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে কি হবে সেটিও কি আমরা ভেবে দেখেছি। গার্মেন্টস শিল্পকে যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদের জীবন ধারণ কিন্তু অনেক কঠিন। বড় শহরে ইট পাথরের সুশোভিত অট্টালিকায় কাজ করছেন, কিন্তু থাকছেন বস্তির কোনো এক ঘরে। আমার দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করবার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন, কিন্তু হঠাৎ যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উপর কোনো আঘাত আসে এবং সেই কারণে যদি এই শিল্পের ধস নামে তখন আমাদের চলমান অগ্রসরমান অর্থনীতির কি হবে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির ফলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অনেকটা সংকটে পতিত হয়েছে। পোশাক শিল্পের একটি বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জানুয়ারি মাসে মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরবর্তী পর্যায়ে শুল্কনীতি নিয়ে অনেক কারসাজি হয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের উপর শুল্ক আরোপ করেছেন। আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহ্রাসকরণও করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ চীনের সাথে আলোচনার আয়োজন হয়েছে জেনেভাতে। দুই দেশ নিজেদের স্বার্থে অনেকটা শিথিল হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুল্কনীতি পরিবর্তন করেছেন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় প্রতিযোগী রাষ্ট্র হচ্ছে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া। পৃথিবীর অন্যতম সস্তার শ্রমবাজার বাংলাদেশে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা স্বল্প টাকা ব্যয় করে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। আমাদের দেশের পণ্যের উপর যে শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তা অনেকটা সংকট তৈরি করেছে আমাদের এই শিল্পের উপর। শুল্কের এই বোঝা বইতে হবে আমাদের। আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের খাতকে। আমাদের পণ্য রফতানিতে যে জটিলতা পোহাতে হয়, যেমন- বাংলাদেশের কাস্টমস, বন্দরের বিলম্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে পণ্য ডেলিভারিতে দেরি হয়, যা মার্কিন ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারতীয় স্থলপথ ব্যবহারে বিধিনিষেধ থাকার ফলে সমুদ্রপথে পণ্য রফতানি করতে হচ্ছে ফলে এখানে ব্যয় বাড়ছে ফলে লাভের থেকে ক্ষতির মুখ দেখতে হচ্ছে। ভারতের সাথে আলোচনার সমস্যার মাধ্যমে সমাধানের জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল না রাখলে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে না। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলিতে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কোনো শব্দ নেই, ঠিক তেমনিভাবে কূটনৈতিক মিশনে শেষ কথা বলে কোনো শব্দ নেই। কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমাদের সেই বিষয়ে নজর দিতে হবে। একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই এটি কিন্ত আমাদের ভাবতে হবে।
মার্কিন সহায়তা বা মার্কিন মুলুকের সাথে আমাদের সম্পর্ক জোরালো করা ছাড়া আমাদেরও কোনো উপায় নেই। শুল্ক নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সাথে তৃতীয় দফা আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের ও পাল্টা শুল্ক”শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন শুল্ক নীতি ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবার কথা থাকলেও প্রস্তুতির জন্য কার্যকরের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে, যা আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়েছে। প্রথমে ৩৭ শতাংশ এবং পরে ৩৫ শতাংশ ঘোষণা করে আলোচনার সুযোগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। শুধু বাংলাদেশ নয়, সবার ক্ষেত্রে একই কৌশল নেন তিনি। নতুন এই শুল্কহারকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সরকার মনে করে যে, কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে বাড়তি শুল্ক কমানো সম্ভব হয়েছে। আর রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাড়তি ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা তাদের জন্য আপাতত স্বস্তির খবর। প্রতিযোগীতার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের বৈদেশিক কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি সফলতা । আমাদের মনে রাখতে হবে চীন এবং ভারতের সাথে আলোচনা চলমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে হয় চাইবে না এই দুটি দেশের সাথে তার চলমান সম্পর্ক খারাপ করবে বা অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পর্ককে ইতিবাচক স্থানে ধরে রাখতে চাইবে। ভূ-রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা চীনের সাথে সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে ট্রাম্প প্রশাসন। একটি কথা মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে যাতে আঘাত না লাগে, সেদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টি রয়েছে। লাভ লোকসানের হিসাবে তার জানা আছে বলেই আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন। একটু দেখে নেওয়া যাক মার্কিন শুল্কনীতিতে অন্যান্য দেশের অবস্থান –
দেশের নাম শুল্কের হার
পাকিস্তান ১৯%
ইন্দোনেশিয়া ১৯%
কম্বোডিয়া ১৯%
বাংলাদেশ ২০%
ভিয়েতনাম ২০%
শ্রীলঙ্কা ২০%
ভারত ২৫%
চীন ৩০%
লাওস ৪০%
আমরা একটু দেখে নেই বিনিময়ে আমাদের কি করতে হবে-
বিনিময়ে যা করতে হবে (যা করতে হবে)
বোয়িং কেনা হবে ২৫ টি
গম কেনা হবে ৩৫ লাখ টন (পাঁচ বছরে)
এনএনজি আমদানি করতে হবে।
তুলা বা সয়াবিন আমদানি বাড়বে। বেসরকারি পর্যায়ে চুক্তি
আমদানি করতে হবে শূণ্য শুল্কে অথবা শুল্ক ছাড়ে।
কিছু কথাও বলা হয়েছে যা হচ্ছে, বাণিজ্যের বাইরে জ্বালানি ও বিদ্যুতে উন্মুক্ত মালিকানা দাবি, চীনের লগ ইংক ব্যবহারে আপত্তি, মেধাস্বত্ব আইন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারসহ কয়েকটি বিষয় শুল্ক আলোচনা জুড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সিপিডি-এর সন্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ বা সে দেশ থেকে অতিরিক্ত আমদানি আমাদের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। ”
এখন আমাদের অনেক কৌশলী হয়ে পা ফেলতে হবে, কারণ ভারত ও চীনের সাথে আলোচনা চলমান। যদি দেখা যায়, চীনের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয় ,তাহলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অনুকূলে চাহিদার সঞ্চালন ঘটতে পারে। আবার মার্কিন বন্ধুত্বের ফলশ্রুতিতে যদি চীন অপেক্ষাকৃত অনুকূল সুবিধা পায়, তাহলে প্রতিযোগিতা তীব্র হতে পারে।
এখন আমাদের পথ চলতে হবে অনেকটা ভেবে চিন্তে। একদিকে ভূ-রাজনীতি, আরেকদিকে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখা।
লেখক: বাপি সাহা, উন্নয়নকর্মী, ই-মেইল: sahabapi998@gmail.com