
|| ভোলা প্রতিনিধি ||
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপাঞ্চল ভোলা জেলা দ্রুতগতিতে একটি শিল্পকেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখানকার প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত, নদীপথে যোগাযোগের সুবিধা এবং কম মূল্যের জমি ও শ্রমিকের কারণে স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকার বড় আকারের উৎপাদন কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
দেশের অন্যতম বৃহত্তম ও বৈচিত্র্যময় ব্যবসায়িক গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল ভোলায় ১০০০ বিঘা জমি কিনে একটি বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। এর জন্য তারা ৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে এবং জমির উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, উর্মি গ্রুপ প্রায় ১০০০ কোটি টাকা (৮০ মিলিয়ন ডলার) ব্যয় করে সিন্থেটিক ও ম্যানমেড ফাইবার উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য জমি নিশ্চিত করেছে।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি (বেজা) একটি চীনা কোম্পানিকে ১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ উপদেষ্টারা ভোলায় গিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বচ্ছলতা কাজে লাগিয়ে একটি বড় ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন।
শিল্পনেতাদের মতে, ভোলার বিপুল গ্যাস মজুত, নদীপথের সংযোগ এবং কম খরচের শ্রমিক ও জমির কারণে এটি এখন বাংলাদেশের নতুন বিনিয়োগের রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, “গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ বা হবিগঞ্জের মতো এলাকায় আর সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। সেখানে জমির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে এবং যানজট অসহনীয়। কিন্তু ভোলায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, জল এবং সস্তা নদীপথের সুবিধা রয়েছে। স্থানীয় শ্রমিক ব্যবহার করে উৎপাদন খরচও কম। আমরা ইতিমধ্যে এর সুবিধা পেয়েছি।”
শেলটেক ২০১৭ সালে ৬০ একর জমিতে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দেশের সবচেয়ে বড় সিরামিক কারখানা স্থাপন করেছে, যা প্রায় ১০০০ চাকরির সৃষ্টি করেছে—যার মধ্যে ৮০০ জন স্থানীয়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ভোলা সদরের চর বেদুরিয়ায় ১০০০ বিঘা জমিতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পপার্ক গড়ে তুলবে। চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “এটি হবে আমাদের হবিগঞ্জের পর দ্বিতীয় বড় শিল্পকেন্দ্র। সরকারকে গ্যাস সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত খরচ করতে হবে না এবং এ অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন শুরু হবে। আমরা গেলে অন্যরাও আসবে এবং একসঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে একটি সম্পূর্ণ শিল্প অঞ্চল গড়ে তুলব।”
কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়েছে এবং ২০২৬ সালে ছোট আকারের উৎপাদন চালু হবে। পুরোপুরি চালু হলে এটি ২৫ হাজারের বেশি সরাসরি চাকরি সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগের জন্য ইকুইটি, ব্যাঙ্ক ঋণ এবং পরবর্তীতে বিদেশী যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণ-আরএফএলের মার্কেটিং পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “পার্কে পাইপ, ফ্লোটার, ইনজেকশন মোল্ডিং পণ্য, চেয়ার, ওয়াটার ট্যাঙ্ক, টেবিল, দরজা, খেলনা, জুতা, সিরামিক ও গ্লাসওয়্যারের মতো উচ্চ-শক্তি খপকারী পণ্যের কারখানা থাকবে। আমরা ২০২৮ সালের মধ্যে পূর্ণ উৎপাদন শুরু করব এবং দেশি-বিদেশী বাজার সরবরাহ করব।” বর্তমানে প্রাণের হবিগঞ্জ শিল্পপার্কে ৩৫ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেন।
রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক উর্মি গ্রুপ ভোলার বেদুরিয়া ইউনিয়নে ৩৫ একর জমিতে ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে সিন্থেটিক ও ম্যানমেড ফাইবার কারখানা গড়ছে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর আসিফ আশরাফ বলেন, “জমি অধিগ্রহণ শেষ করে ৪০-৫০ শতাংশ উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে উৎপাদন চালু হবে।” এর উদ্দেশ্য উর্মির গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল ইউনিটের জন্য ফাইবার সরবরাহ করা এবং অতিরিক্ত পরিমাণ রপ্তানি করা। তিনি যোগ করেন, “এখন সব সুতা ও কাপড় আমদানি করতে হয়। ঢাকা বা চট্টগ্রামের কাছে আর উপযুক্ত জমি বা গ্যাস নেই। ভোলায় সবকিছু রয়েছে এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের নদীপথ সংযোগ আছে। বিনিয়োগের রিটার্ন ভালো।” উর্মি গ্রুপের গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, কৃষি, শিপিং ও লজিস্টিক্সে ১৫ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছে।
বেজা ২৬ আগস্ট চীনা উৎসের লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ভোলা ইকো ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক জোনের অনুমোদন দিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১০২ একর জমি কভার করে পরে ১৫৮ একরে বিস্তার হবে, যাতে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। এখানে ৪০টি পরিবেশবান্ধব, শ্রমকর্মী ও কৃষিনির্ভর শিল্প থাকবে—যেমন মাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাংস-দুগ্ধ, কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্প। চীন ফ্রি ট্রেড জোন অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যান লি বলেন, “ভোলায় ফ্রি ট্রেড জোন গড়লে স্থানীয় কৃষিপণ্য, মাছ, চাল ও ফল চীনে রপ্তানির বড় সুযোগ তৈরি হবে। আমরা চেংডুর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ভোলার পণ্য প্রদর্শন করব।”
১৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা—আদিলুর রহমান খান (ইন্ডাস্ট্রিজ, হাউজিং অ্যান্ড পাবলিক ওয়ার্কস), মুহাম্মদ ফৌজুল কবির খান (পাওয়ার, এনার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস) এবং স্ক. বশির উদ্দিন (কমার্স, টেক্সটাইলস অ্যান্ড জুট)—বেদুরিয়া ফেরিঘাটের কাছে দুটি সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেন। আদিলুর বলেন, “ভোলায় অন্য কোথাওর চেয়ে বেশি গ্যাস রয়েছে। এটি ইউরিয়া কারখানায় ব্যবহার করব এবং সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন চলছে।” তিনি জানান, দেশের ৩৪টি পরিকল্পিত সার সংরক্ষণের বাফার গুদামের একটি ভোলায় নির্মাণাধীন এবং ২০২৭ সালের মধ্যে চালু হবে।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ইঞ্জিনিয়ার ওলিউর রহমান বলেন, “শেলটেক, কাজী ফার্মসসহ অনেক কোম্পানিতে পাইপলাইন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। প্রাণ-আরএফএল ও উর্মি গ্রুপও পাবে। বিএসসিআইসি শিল্প এস্টেটে গ্যাস চালু হয়েছে এবং সরকারি ইউরিয়া কারখানার প্রস্তুতি চলছে।”
পূর্ববর্তী ভোলা ডেপুটি কমিশনার এমএ জাহাঙ্গীর বলেন, “স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহে ভোলা দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হবে। কারখানাগুলো চালু হলে ভোলার কোনো যুবক বেকার থাকবে না।” তিনি জানান, নিয়ম মেনে আবেদন করলে সব শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে।
ভোলার এই শিল্পায়নের ঢেউ দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
