|| প্রফেসর ড. আ ব ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, ইবি, কুষ্টিয়া ||
যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং ২০২৪-এর তালিকায় শীর্ষ ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।
এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা না থাকলেও মাথাব্যথা হচ্ছে পার্শ্ব দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিয়ে। ৩০০ এর মধ্যে ভারতের ৪০টি এবং পাকিস্তানেরও ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এটি আরো আমাদের বড় কষ্টের কারণ হয়েছে।
কয়েকদিন থেকেই ফেসবুকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংএ পিছিয়ে পড়া নিয়ে চাউর হচ্ছে এবং আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে চলছে।
এ বিষয়টি নতুন কিছু নয় প্রতিবছরই আমরা এই দৃশ্যটি দেখতে পাই।
এরপর আমরা সমালোচকরা শুধু সমালোচনা করেই দায়মুক্ত হচ্ছি। কিন্তু এর কারণ এবং কারণগুলোর প্রতিকারের বিষয় আমাদের কোনো চিন্তা পরামর্শ সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
আর আমরা চিন্তাবিদ চিন্তাশীল গবেষকরা একবারও আমাদের এই পিছিয়ে পড়ার বিষয় নিয়ে কখনো চিন্তা গবেষণা করি না।
আলহামদুলিল্লাহ দেশের সরকারি বেসরকারি মিলে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা এখন দেড়শতাধিক। ছোট্ট একটি দেশের জন্য এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অবশ্যই উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক। তাই সংখ্যার দিক থেকে বিচার করলে র্যাঙ্কিংএ বাংলাদেশের অবস্থান ৫ এর নিচে যাবে না, বরং উপরেই থাকবে।
আমরা জানি, যেকোনো জিনিসের মানের বিষয়টি নির্ভর করে সবসময় কোয়ান্টিটি বা সংখ্যা নয়, কোয়ালিটি বা মানের উপর ।
বিশ্ববিদ্যালয় মানে দেশের উচ্চশিক্ষার অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার মান উন্নয়নে জ্ঞান গবেষণা আবিষ্কার যার প্রধান কাজ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস বা পাঠ্যসূচিতে নির্ধারিত কোনো গ্রন্থ পাঠ্যভুক্ত থাকে না। থাকে নির্ধারিত কিছু বিষয়।
নির্ধারিত কিছু বিষয়ের একেকটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ ২-১০ লেকচার দিয়ে থাকেন।
আর শিক্ষার্থীরা সেই লেকচার অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ লাইব্রেরীতে বসে গবেষণা করে টিউটোরিয়াল/অ্যাসাইনমেন্ট নামে ছোট গবেষণা পত্র রচনা করে থাকেন।
স্নাতক প্রথম বর্ষেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি কোর্স এর অধীনে টিউটোরিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট নামে ৩-৬ টি পর্যন্ত এ ধরনের ছোট ছোট গবেষণা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ে এটাই গবেষণার প্রথম হাতে খড়ি।
এরপর স্নাতক চতুর্থ বর্ষ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফিল্ড ওয়ার্ক, এসাইনমেন্ট, গবেষণা প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে আরো বড় বড় গবেষণাপত্র রচিত হয়ে থাকে।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর পর এমফিল, পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরেট নামে আরো বৃহৎ গবেষণাপত্র রচিত হয়ে থাকে। এসব গবেষণার মাধ্যমে প্রতিটি গবেষক, ছাত্র দেশ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল বিষয়ে এক একটি আলাদা অনন্যধর্মী গবেষণাপত্র রচনা করে থাকেন। যা দেশ জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের দেড়শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলো বিশেষায়ীত বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিজ্ঞানমুখী, বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান গবেষণার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংএ কিসের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ণয় করা হয়, সে বিষয়ে আমার তত ধারণা নেই। তবে মৌলিক যে বিষয়গুলো র্যাঙ্কিংএ বিবেচনা করা উচিত সেগুলো হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং আবিষ্কার। শুধু গবেষণা এবং আবিষ্কার নয় এগুলো দেশ ও মানবজাতির উন্নয়নে কতটুকু অবদান রাখবে সেটাও বিবেচনায় আসা উচিত।
বিশ্বের এখন জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট। ক্রিকেট খেলায় একজন ক্রিকেটারের তার বোলিং, ব্যাটিং, ব্যাটিংয়ে ক্যাচ, ডট বল, খেলার শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিবেচনা করে এক একজন প্লেয়ারকে প্রতিটি খেলায় ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ, ম্যান অফ দ্যা সিরিজ, ক্যাপ্টেন্সি ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার শিক্ষাজীবনে কোন কিছুই কাউন্ট করার এমন কোন ব্যবস্থা নেই। দু একটি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেটাও হয় না।
তাই আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাঙ্কিংএ নিজের অবস্থান করে নেওয়ার জন্য যেসব মৌলিক বিষয় নির্ধারণ করা উচিত সেগুলো হলো-
শিক্ষকের বিষয়ে প্রস্তাবনা
১. একজন শিক্ষকের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি, ক্লাসে উপস্থিতি, পাঠদান সময়, পাঠদানের বিষয়বস্তু, পাঠদানের উপস্থাপনা, পাঠের উপযোগিতা, পাঠ্য বিষয়টির মান নির্ধারণ, শিক্ষার্থীদের উপযোগী বক্তৃতা, বাস্তব জীবনে এই বক্তব্য কতটুকু উপকারী, শিক্ষার্থীকে পথনির্দেশনা দানে বক্তব্যটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য, গবেষণার ক্ষেত্রে তার বক্তব্যটি কতটুকু কার্যকর ইত্যাদি বিশ্লেষণ অবশ্যই প্রয়োজন।
২. একজন শিক্ষকের নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ছাত্রদের প্রতি স্নেহশীলতা, শিক্ষার্থীদের আপন করে নেওয়ার মানসিকতা, শিক্ষার্থীদের দেশ-জাতির জন্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আগ্রহ, চেষ্টা, শ্রম, গবেষণা ইত্যাদিও বিবেচনায় আনা।
৩. ক্লাসের বাইরে একজন শিক্ষক তার নিজস্ব কক্ষে কতজন শিক্ষার্থীকে কাউন্সিলিং করেন, সুপরামর্শ দেন, তার না বুঝা বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেন, তাকে গবেষণামুখী করতে সহযোগিতা করেন, আবিষ্কারের বিষয়ে তার প্রচেষ্টা ব্যয় করেন সেটিও কাউন্ট করতে হবে।
৪. নিজস্ব বিভাগের বাইরে অনুষদভুক্ত অন্য বিভাগ, অন্য অনুষদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শ্রেণীর যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য তিনি কতটুকু শিক্ষক হিসেবে আদর্শ আইডল, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তার কথা-কাজ, আচার-আচরণ, ব্যবহার, বক্তব্য ইত্যাদি কতটুকু উপকারী, সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে।
৫. নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় তার প্রভাব গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, সে বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।
৬. শিক্ষকের বছরে তার আর্টিকেল গবেষণা রচনা কতটুকু হয়েছে, এর মধ্যে কতগুলো তার শিক্ষার্থী তার বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশ জাতির উন্নয়নে কাজে এসেছে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।
৭. শিক্ষকের বিষয়ে বিভাগ, অনুষদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক, সহকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানদের এসেসমেন্টে আসা দরকার।
৮. একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের বক্তব্য কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো, কতটুকু শিখতে পারলো, পারলেও জানতে বা বুঝতে পারলো, তার এই বুঝ অনুযায়ী কতটুকু সে ব্যক্ত বা বক্তব্য রাখতে পারলো, কতটুকু সে লিখতে পারলো, কতটুকু সে হজম করতে পারলো, কতটুকু সে অর্জন করে সে অর্জন অনুযায়ী দেশ জাতিকে কিছু দেওয়ার কতটুকু সক্ষমতা অর্জিত হলো এগুলো বিবেচনায় আনা উচিত।
৯. একটি শিক্ষাবর্ষে কতজন শিক্ষার্থী, গবেষক, লেখক, উদ্ভাবনকারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারলো, কর্মজীবনে শিক্ষার্থীরা কতটুকু সফলতা কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের কি কি উন্নয়নে তার জ্ঞান গবেষণা কাজে লাগলো সেগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
১০. গবেষণায় আগ্রহী করতে গবেষণায় সর্বোচ্চ বাজেট প্রদান।
১১. প্রতিটি গবেষণা প্রবন্ধ/ গ্রন্থের জন্য একটি করে ইনক্রিমেন্ট প্রদান।
১২. সকল গবেষণাপত্র ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খরচে প্রকাশ করা।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রস্তাবনা
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরে আরেকটি বড় যোগ্যতার প্রয়োজন সেটা হল রাজনৈতিক লিংক। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররাও নির্বাচনী বোর্ডে অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে বিদায় দিতে বাধ্য হয়। এ বিষয়টিকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অসুস্থ রাজনীতি
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে এই অসুস্থ রাজনীতি প্রধানত দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়, পড়ালেখা, হলে অবস্থান, পরীক্ষা এবং ফলাফলে রাজনৈতিক প্রভাব কি অস্বীকার করা যায় না।
শিক্ষার্থীদের বিষয়ে প্রস্তাবনা
১. প্রতিটি শিক্ষার্থী হবেন আবাসিক।
২. হলে অবস্থান নিশ্চিতকরণ।
৩. প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য স্কলারশিপ এর ব্যবস্থা।
৪. হলে খাবারের মান নিশ্চিতকরণ।
৫. উন্নতমানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
৬. শিক্ষার্থীদেরকে রাজনীতিমুক্ত রাখা।
৭. মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কৃত করা।
৮. প্রথম স্থানপ্রাপ্ত চৌকস শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগে নিশ্চিতকরণ।
৯. গবেষণা ইন্সট্রুমেন্ট পর্যাপ্ত সরবরাহ করা।
১০. গবেষণায় পর্যাপ্ত স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা।
প্রশাসনিক বিষয়ে প্রস্তাবনা
১. পিএসসির মতো ইউজিসি কর্তৃক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ড সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের একসাথে লিখিত মৌখিক পরীক্ষা এবং অন্যান্য যোগ্যতার পরীক্ষা থাকা বাঞ্ছনীয়।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির নামে অসুস্থ রাজনীতি বন্ধ করা।
৩. প্রয়োজনে রাজনীতির জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা যেখানে শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি সাবজেক্ট থাকবে এবং সেখানে প্রচলিত রাজনীতি বিষয়ে যা কিছু আছে আলাদা আলাদা সাবজেক্ট সেখানে ওপেন করে সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা।
৪. রাজনীতি প্রভাবমুক্ত অ্যাকাডেমিক ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা।
৫. গবেষণা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বাজেট এবং এই বাজেটের যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা।
৬. গবেষণায় যোগ্য ও আগ্রহীদের গবেষণা ক্ষেত্রে নিয়োগ করা।
৭. বিদেশি ডিগ্রী প্রাপ্তদের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরি বাধ্যতামূলক করা।
৮. প্রতিটি শিক্ষকের ক্লাস, লেকচার, প্রবন্ধ, গ্রন্থ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, গবেষণা তত্ত্বাবধান ইত্যাদি ডাটা সংরক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী শিক্ষকদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।
৯. শিক্ষকদের গবেষণা প্রবন্ধ এবং গবেষণা থিসিসগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে প্রকাশ করা।
১০. বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে র্যাঙ্কিংএ প্রথম সারিতে থাকে, তাদের সে বিষয়গুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুসরণ করা।
এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে আমার বিশ্বাস শুধু এশিয়া মহাদেশে নয় বিশ্ব র্যাঙ্কিংএও আমরা ১০০এর মধ্যে থাকতে পারবো।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং সাবেক ডিন, থিওলজী এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।