
|| আব্দুর রহিম ||
বাংলাদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অথচ এইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া জন্য ইনস্টিটিউট রয়েছে মাত্র একটি। যা বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট [বিএমটিটিআই ] নামে পরিচিত। বৃহৎ এই শিক্ষক সমাজের সকলকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা একটি মাত্র ইনস্টিটিউটের পক্ষে সম্ভব নয়। যার ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাশের হার ক্রমান্বয়ে কমতেছে। নতুন কারিকুলামের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারছেন না অধিকাংশ শিক্ষক। অনেকে এর কারণ হিসেবে কার্যকর প্রশিক্ষণের অভাবকেই দায়ি করছেন।NTRCA- থেকে সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদেরকে ১মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদানে পাঠানো হচ্ছে।
অনেকে আবার বিএমটিটিআই অনেক দূরে হওয়ার কারণে যেতে পারছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে বিএমটিটিআই অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করলেও নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে ঠিকভাবে যুক্ত হতে পারছেন না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এমন অনেক মাদ্রাসা আছে যাদের একজন টিচারও বিএমটিটিআই থেকে কখনো প্রশিক্ষণ নেন নাই। আবার এমন অনেক শিক্ষক আছেন তারা বিএমটিটিআই এর নামও শুনেন নাই। তাই মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে অন্তত প্রতিটি বিভাগে একটি করে মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।যদিও এখন বিভাগীয় পর্যায়ে সীমিত আকারে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ চালু হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ এই মাদ্রাসায় রয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী।তাদেরকে দক্ষ জনসম্পদে রুপান্তর করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। আর দক্ষ শিক্ষক হিসেবে তৈরি করতে প্রয়োজন মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। তখন এই স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করা সম্ভব। যদিও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের [বাউবি] অধীনে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকের জন্য চালু হয়েছে “ব্যাচেলর অব মাদরাসা এডুকেশন [বিএমএড ]। এটা অনেকটা শিক্ষকদের বিএড স্কেল পাওয়ার জন্য বেশি কার্যকর বলে অনেকে মনে করেন। আবার এই কোর্স সম্পন্ন করতে সকল ব্যয় শিক্ষকরা নিজেরাই বহণ করে থাকেন। মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিএড ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো মাদ্রাসার সুপার ও অধ্যক্ষ নিয়োগে বিএড বা বিএমএড ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু, কেন বাধ্যতামূলক হবেনা? যিনি একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন এবং প্রশাসনিক সব দায়-দায়িত্ব তার উপরে থাকবে। তিনি কেন এসব বিষয়ে জানবেন না?
প্রত্যেক পেশার মানুষের কিছু পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে যা তার পেশাগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।একইভাবে যাঁরা শিক্ষক তাঁদের কিছু পেশাগত বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। যেমন: যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক তাঁর সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। আবার শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চাই তার থেকেও তা কীভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।এছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতি, শিক্ষা দর্শন, শিক্ষা বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন স্তরের (ইবতেদায়ী, দাখিল ও আলিম) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রয়োজন। আর এর জন্যই প্রয়োজন মাদ্রাসা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের।বাংলাদেশে মাদ্রাসার তুলনায় এই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট খুবই নগন্য। এতোগুলো মাদ্রাসার শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে মাত্র একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। যা ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরে গাজীপুর, বোর্ড বাজারে। এই মাদ্রাসা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মাদ্রাসার ইবতেদায়ী স্তরের শিক্ষক, ইবতেদায়ী প্রধান, দাখিল স্তরের শিক্ষক, আলিম স্তরের প্রভাষক এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকে সুনামের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। তবে এতোগুলো শিক্ষকদের জন্য একটি মাত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থাকা খুবই দুঃখজনক। এর ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়:
১. দূরে হওয়ার কারণে অনেকেই যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
২. মহিলা শিক্ষকদের জন্য এটা বেশি কষ্টকর।
৩. এতদূরে গিয়ে অনেক দিন একসাথে থাকা অনেকের জন্য সম্ভবপর হয় না।
৪. খরচের বিষয়টি প্রশিক্ষণ নেয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসে।
√সমস্যা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে:
১. প্রতিটি বিভাগে বা জেলায় একটি করে মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করা যেতে পারে।
২. অথবা প্রতিটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট শাখা চালু করা যেতে পারে।
এর ফলাফল :
১. এর মাধ্যমে সকল মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিষয় ভিত্তিক ট্রেনিং নিশ্চিত করা যাবে।
২. মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে।
৩. পিএসসিতে আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ এবং ইসলামিক অ্যাইডলজির শিক্ষা ক্যাডারে পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করেন।সারা দেশে মোট ৫টি HSTTI রয়েছে।
১. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।
২. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, রাজশাহী।
৩. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, খুলনা।
৪. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, বরিশাল।
৫. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা।
টিচার্স ট্রেনিং কলজেসমূহ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।সারা দেশে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ রয়েছে ১৪টি।
১. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা।
২. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,ময়মনসিংহ।
৩. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ[মহিলা ], ময়মনসিংহ।
৪. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,চট্টগ্রাম।
৫. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,কুমিল্লা।
৬. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,ফেনী।
৭. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,যশোর।
৮. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,খুলনা।
৯. সরকারি টিচার্স ট্রেনি কলেজ,রাজশাহী।
১০. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,রংপুর।
১১. শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বরিশাল।
১২. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,ফরিদপুর।
১৩. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,সিলেট।
১৪. সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,পাবনা।
এইসব কলেজসমূহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিম্নোক্ত কোর্সসমূহ অফার করা হয়। ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বি.এড, ডিপ্লোমা ) ১ বছর মেয়াদি। মাস্টার অব এডুকেশন (এম.এড) ১ বছর মেয়াদি। ব্যাচেলর অব এডুকেশন (অনার্স) ৪ বছর মেয়াদি।এছাড়াও কিছু পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত ও সান্ধ্যকালীন বিএড ও এমএড প্রোগ্রাম চালু রয়েছে।
বর্তমানে মাদ্রাসার মাধ্যমিক( দাখিল) স্তরের শিক্ষকদের জন্য একটি কোর্স চালু রয়েছে। এই কোর্সের ব্যয় সম্পূর্ণ শিক্ষকরা নিজেরাই বহণ করে থাকেন।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) এর অধীনে পরিচালিত ব্যাচেলর অব মাদরাসা এডুকেশন [বিএমএড ] এর স্টাডি সেন্টার :
১. বাংলাদেশ মাদসারা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট [বিএমটিটিআই ], বোর্ড বাজার গাজীপুর।
২. সরকারি আলীয়া মাদরাসা, ঢাকা।
৩. জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া [আলীয়া] মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
৪. ইসলামিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা, কুমিল্লা।
৫. সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা, সিলেট।
৬. মোমেনশাহী ডি. এস. কামিল মাদরাসা, ময়মনসিংহ।
৭. সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদরাসা, বগুড়া।
৮. মুলাটোল মদীনাতুল উলুম [কামিল] মাদরাসা, রংপুর।
৯. রাজশাহী দারুস সালাম কামিল মাদরাসা, রাজশাহী।
১০. যশোর আলিয়া মাদরাসা, যশোর।
১১. সবজাননেসা মহিলা কামিল মাদরাসা, ফরিদপুর।
১২. খুলনা আলিয়া[ কামিল] মাদরাসা, খুলনা।
১৩. সাগরদী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, বরিশাল।
এই সব স্টাডি সেন্টারে অধিকাংশেই আধুনিক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং আধুনিক শিক্ষা উপকরণ নেই বললেই চলে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বিভাগীয় টিচার্স ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট এবং সরকারি পিটিআই এ ক্লাস্টার ভিত্তিক চালু করা হোক।
লেখক: আব্দুর রহিম, সাবেক শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।