
“আমাদের সময় (নকল)”, “বাংলার সময়”, “প্রাইম টেন টিভি”, “ঢাকা ক্যানভাস”, “বাংলাদেশ টাইমস (নকল)”, “ঢাকা ওয়াচ টুইন্টিফোর ডটকম” নাম ব্যবহার করে প্রতারণা — (একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট)
|| শেখ শাহরিয়ার | জেলা প্রতিনিধি (খুলনা) ||
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একাধিক ‘দৈনিক’ ও ‘টিভি’ প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়োগ–প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে— “দৈনিক আমাদের সময়”, “বাংলার সময়”, “প্রাইম টেন টিভি”, “ঢাকা ক্যানভাস”, “বাংলাদেশ টাইমস (নকল)” এবং “ঢাকা ওয়াচ টুইন্টিফোর ডটকম” নাম ব্যবহার করে একাধিক পেজ ও প্রোফাইল থেকে মানুষকে সাংবাদিক বা প্রতিনিধি বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রতারকরা সাধারণত ফেসবুকে নকল নিয়োগ বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এবং আগ্রহীদের ইনবক্স বা হোয়াটসঅ্যাপে নিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করে। সেখানে ৪২৫০ টাকা বা ২০৫০ টাকার বিনিময়ে ‘আইডি কার্ড’, ‘জ্যাকেট’, ও ‘অফিসিয়াল পরিচয়’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা অফিসিয়াল লোগো, ঠিকানা ও পত্রিকার নাম ব্যবহার করে প্রতারণার আড়াল তৈরি করে।
“দৈনিক আমাদের সময়” খেতাবে প্রতারণা
গত কয়েকদিনে “দৈনিক আমাদের সময়”-এর নামে ফেসবুকে প্রকাশিত নকল নিয়োগ বিজ্ঞাপন এবং সরাসরি মেসেজের মাধ্যমে প্রতারণার একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ— প্রতারকরা নিজেদের “দৈনিক আমাদের সময়”-এর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে চাকরির প্রস্তাব দেয় এবং পরবর্তীতে অর্থ দাবি করে।
এক ভুক্তভোগী জানান, তাঁকে বলা হয়েছিল, “তাকে সংবাদকর্মী বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।” যোগাযোগ করা হয় মোবাইল নম্বর ০১৭৯০-১৭৯২০৫ এবং ই-মেইল dailyamadershomoycv@gmail.com ঠিকানা থেকে। তাঁকে বলা হয়, ৪২৫০ টাকা বা ২০৫০ টাকা প্রদান করলে “অফিসিয়াল জ্যাকেট, আইডি কার্ড এবং প্রতিনিধি-সুবিধা” দেওয়া হবে।
ভুক্তভোগী বলেন,
“তারা বলেছিল, আমার ছদ্মনাম ব্যবহার করে আমাকে অফিসিয়াল আইডি ও জ্যাকেট দেবে। প্রথমে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম, পরে বুঝতে পারলাম এটি প্রতারণা। তখন আর টাকা দেইনি।”
যাচাই করে দেখা যায়— উল্লিখিত ইমেইল বা মোবাইল নম্বরটি “দৈনিক আমাদের সময়”-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট dainikamadershomoy.com-এর যোগাযোগ তথ্যের সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ এই বিজ্ঞাপনটি ভুয়া এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
একই কৌশলে প্রতারণা — নতুন নতুন নাম
তদন্তে জানা গেছে, “দৈনিক আমাদের সময়” ছাড়াও একই কৌশলে “বাংলার সময়”, “প্রাইম টেন টিভি”, “ঢাকা ক্যানভাস”, “বাংলাদেশ টাইমস (নকল)” এবং “ঢাকা ওয়াচ টুইন্টিফোর ডটকম” নাম ব্যবহার করে মানুষকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে।
এই পেজ বা প্রোফাইলগুলো সাধারণত সদ্য তৈরি, ফলোয়ার সংখ্যা অল্প, এবং প্রায় সব পোস্ট নিয়োগ-সংক্রান্ত। তাদের পোস্টে দেখা যায়— “সাংবাদিক নিয়োগ চলছে”, “প্রতিনিধি নেওয়া হচ্ছে”, “সীমিত পদে আবেদন” ইত্যাদি বার্তা।
এদের অনেকেই সরকারি ধাঁচের ভাষা ব্যবহার করে যেন অফিসিয়াল মনে হয়।
একই ছবি, লোগো ও ভাষা ব্যবহার করে একাধিক ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামের “নিয়োগ পোস্ট” শেয়ার করা হচ্ছে— কখনও “আমাদের সময়”, কখনও “বাংলার সময়”, কখনও “প্রাইম টেন টিভি” ইত্যাদি। এতে ভুক্তভোগীরা বিভ্রান্ত হন, কারণ নামগুলো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের নামের কাছাকাছি।
প্রতারণার ধাপ
১, ফেসবুকে বিজ্ঞাপন পোস্ট করা হয় — “সাংবাদিক নিয়োগ চলছে”, “প্রতিনিধি দরকার” ইত্যাদি শিরোনামে।
২, আগ্রহীরা পোস্টে মন্তব্য করলে তাদের ইনবক্সে মেসেজ পাঠানো হয় বা হোয়াটসঅ্যাপে নেওয়া হয়।
৩, এরপর নির্দিষ্ট ফি (৪২৫০ টাকা বা ২০৫০ টাকা) জমা দিতে বলা হয় বিকাশ/নগদ/রকেটের মাধ্যমে।
৪, টাকা পাঠানোর পর “আইডি কার্ড, জ্যাকেট, প্রতিনিধি নিয়োগপত্র” পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
৫, অর্থ পাঠানো হলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় অথবা ব্লক করে দেওয়া হয়।
প্রতারকরা অফিসিয়াল লোগো, তেজগাঁও ঠিকানা, এমনকি অফিস ভবনের ছবি ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তারা প্রথমে বিজ্ঞাপন দেখে বিশ্বাস করেছিলেন এটি আসল, কারণ লোগো ও নাম আসল প্রতিষ্ঠানের মতো ছিল। কেউ কেউ টাকা দেওয়ার পর যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। কেউ আবার সতর্ক হয়ে পেমেন্টের আগে প্রতারণা টের পেয়ে যান।
একজন বলেন, “আমি বিশ্বাস করেছিলাম কারণ তারা বলেছিল অফিস তেজগাঁওয়ে, অফিসিয়াল আইডি আছে। কিন্তু টাকা চাওয়ার পর সন্দেহ হয়।”
আরেকজন বলেন, “আমাকে বলা হয়, ২০৫০ টাকা দিলে আইডি, জ্যাকেট, প্রতিনিধি-পদ সবই পাব। টাকা চাওয়ার পর বুঝলাম এটা ফাঁদ।”
প্রতারণার কৌশল বিশ্লেষণ
সামাজিক মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রতারণায় দেখা যায় কিছু সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক কৌশল—
১. প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা সৃষ্টি: প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের নাম, লোগো, এবং অফিস ঠিকানা ব্যবহার করে বিশ্বাস তৈরি।
২. সামাজিক প্রমাণ: পেজে পুরোনো পোস্ট, জ্যাকেটের ছবি, “নিয়োগপত্রের নমুনা” ইত্যাদি যুক্ত করে আস্থা বাড়ানো।
৩. তাড়াহুড়ো তৈরি: “শেষ তারিখ আজ”, “সীমিত পদ”, “প্রথমে আবেদনকারী পাবেন” ইত্যাদি বলে সিদ্ধান্তে চাপ দেওয়া।
৪. কম টাকার প্রলোভন: কম ফি দেখিয়ে মানুষকে দ্রুত রাজি করানো।
৫. অফিসিয়াল কাগজের ভান: পিডিএফ ফরম্যাটে নকল ‘নিয়োগপত্র’ বা ‘আইডি নমুনা’ পাঠানো হয়।
পুলিশের বক্তব্য ও করণীয়
পুলিশ সদর দপ্তর ও সাইবার সেল জানিয়েছে, ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের প্রতারণা এখন নিয়মিতভাবে হচ্ছে।
তারা পরামর্শ দিয়েছে—
• সন্দেহজনক পেজ বা প্রোফাইল দেখলে স্ক্রিনশট নিয়ে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন (CID)–এ অভিযোগ দিন।
• জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন করুন বা স্থানীয় থানায় লিখিত অভিযোগ করুন।
• বিকাশ বা নগদ ট্রান্সফার হয়ে থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে অপারেটরকে জানান— যাতে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা যায়।
• ফেসবুকে রিপোর্ট করে পেজ বা পোস্ট ব্লক করার অনুরোধ করুন।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া
“দৈনিক আমাদের সময়”-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইমেইল ও প্যাবএক্স নম্বরের সঙ্গে ভুয়া বিজ্ঞাপনে দেওয়া যোগাযোগের কোনো মিল নেই। পত্রিকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমাদের অফিস কোনোভাবেই জিমেইল বা ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করে নিয়োগ দেয় না। কেউ আমাদের নাম ব্যবহার করলে সেটি পুরোপুরি প্রতারণা।”
এছাড়া “বাংলার সময়” ও “বাংলাদেশ টাইমস”-এর পক্ষ থেকেও এমন বিজ্ঞাপনের বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে যে, “অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোথাও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় না।”
পাঠকদের সতর্কতা
• অফিসিয়াল ডোমেইন ছাড়া (যেমন @dainikamadershomoy.com বা @banglartime.com ইমেইলে চাকরির প্রস্তাব বিশ্বাস করবেন না।
• কেউ ফি চায় কিনা তা যাচাই করুন। অফিসিয়াল নিয়োগে কখনও অগ্রিম টাকা নেওয়া হয় না।
• ফেসবুক ইনবক্স বা হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া নিয়োগের প্রতিশ্রুতি সাধারণত প্রতারণা।
• অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করে যাচাই করুন, পোস্ট বা মেসেজ নয়।
• প্রতারণার প্রমাণ (স্ক্রিনশট, রসিদ, মেসেজ) সংরক্ষণ করে থানায় বা সাইবার সেলে অভিযোগ করুন।
উপসংহার
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে যে, ফেসবুকে বিভিন্ন “দৈনিক” ও “টিভি” নাম ব্যবহার করে নিয়োগের প্রলোভনে প্রতারণা চলছে। এটি শুধু সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না, বরং সাংবাদিকতা-পেশার ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করছে।
পাঠকদের প্রতি আবেদন: কেউ যদি এমন কোনো “চাকরি অফার” দেখেন যেখানে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের নাম ব্যবহার করে অর্থ দাবি করা হয়, তাহলে দ্রুত থানায় ও সাইবার সেলে রিপোর্ট করুন এবং প্রকৃত সংবাদমাধ্যমকে অবহিত করুন। এতে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা রোধ করা সম্ভব হবে।
