
|| রাসেল আহমদ | ঢাকা আলিয়া প্রতিনিধি ||
জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশজুড়ে চলা ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’র শিক্ষার্থী মোঃ আরিফুল ইসলাম রেজা। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শরীরে এখনো রয়েছে ২৭৬টি শর্টগানের গুলি। বারবার চিকিৎসা ও সহায়তা চেয়েও তিনি উপেক্ষিত। এমনকি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ থেকেও পাননি কোনো সহানুভূতি, সহায়তা বা ফোন কল ।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর আন্দোলন ছিল দেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের আরেকটি বলিষ্ঠ জাগরণ। সেই আন্দোলনের এক সাহসী অংশগ্রহণকারী, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মোঃ আরিফুল ইসলাম রেজা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ের উত্তাল আন্দোলনে তিনি শুধু অংশগ্রহণ করেননি—গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁর জীবন কাহিনী যেন এক জীবন্ত ইতিহাস।

রেজা ঢাকার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা-র শিক্ষার্থী। আন্দোলনের সময় তিনি আলিম পরীক্ষার্থী (HSC) সরাসরি মাঠে থাকার সুযোগ না পেলেও, ১৬ জুলাই পরীক্ষার পরপরই তামিরুল মিল্লাত কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভে যুক্ত হন। ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু সেদিনই ঘটে যায় জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা।
রেজা বলেন, ১৮ জুলাই, যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। “আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। অন্য শিক্ষার্থীরা আমাকে কাঁধে করে হসপিটালে নিতে থাকে, তখনো আমার জ্ঞান ছিল,” বলেন আরিফ।
তখনও তাঁর চোখ খোলা ছিল, মোবাইল ফোনটি কাউকে দিয়ে বলেন যেন সেটা হসপিটালে পৌঁছে দেওয়া হয়—সেই ফোনে ছিল গুলি চালানোর নির্দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ফোন আর ফেরত পাওয়া যায়নি। জানালেন তিনি।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা তার পরিবারের খোঁজ নিতে চাইলে তিনি কিছু বলতে পারেননি। পরে অনেক কষ্টে নিজের বড় ভাইয়ের নাম্বার বলে অবস্থান জানান দেন। তাকে যাত্রাবাড়ীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। এরপর ১৯ জুলাই জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়।
চিকিৎসার মাঝেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। “আমি কথা বলতে পারতাম না, উঠতে পারতাম না, তারপরও দিনে তিনবার পুলিশ এসে ছবি তোলে, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত কিনা জানতে চায়,” বলেন আরিফ। তার পরিবারের বারবার জানানো সত্ত্বেও যে সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, সন্দেহের চোখে তাকানো থামেনি।
৩ আগস্ট তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে গেলেও ভর্তি নেওয়া হয়নি। “হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে দুইদিন চিকিৎসা নিই। এরপর ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ হামলার খবর পেয়ে রাতেই পালিয়ে গাজীপুর যাই,” বলেন তিনি।
তখন দেশজুড়ে উত্তেজনা, গুজব। সেনাপ্রধানের ভাষণ, প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগের খবর। আরিফ বলেন, “আমি অসুস্থ শরীরে রাস্তায় নেমে দেখি বিজয় মিছিল, খুশিতে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে যাই।”
পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল এবং সিএমএইচ-এ চিকিৎসা নিলেও কোনো স্থায়ী সমাধান মেলেনি। “ডান হাতে এখনো শক্তি নেই, হাত অবশ হয়ে যায়, প্রচণ্ড জ্বালা করে,” বলছিলেন তিনি।
চিকিৎসক ও সহানুভূতিশীল মানুষেরা পাশে দাঁড়ালেও, কিছু কষ্ট রয়েই গেছে আরিফের । “আমি যে প্রতিষ্ঠানে পড়ি—সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা—সেখান থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি,” বলেন রেজা। ঢাকা আলিয়ার স্যারদের ও অধ্যক্ষকে জানালেও কোন সহযোগিতার আশ্বাস পাইনি অন্যদিকে, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এক লক্ষ টাকা চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে।
তিনি এখনো উন্নত চিকিৎসার অপেক্ষায়, সরকারি সহযোগিতা চান। “আমি কোনো অপরাধ করিনি, দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলাম, তার শাস্তি এতটা নির্মম হবে বুঝিনি,” আরিফের কণ্ঠে বেদনার সঙ্গে প্রতিবাদের সুর।