
|| নিজস্ব প্রতিবেদক ||
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও লক্ষ লক্ষ মাদরাসা ছাত্রদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ‘বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার’র সাবেক ঢাকা মহানগরীর নেতা মাওলানা আব্দুস সোবহানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী আজ ২৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার)। ছাত্রশিবিরের একদল নেতাকর্মীদের পৈশাচিক আক্রমনের শিকার হয়ে তিনি ১৯৭৮ সালের এই দিন সকাল ৭টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় তাঁর অকালে ঝড়ে যাওয়া জমিয়ত কর্মীদের হৃদয়ে আজও রক্ত ঝড়াচ্ছে।
জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা রক্ষা এবং এর যুগপোযোগি মানোন্নয়ন করতে। এলক্ষ্যে সংগঠনের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী যুগে যুগে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে নিজেদের শরীরের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে। কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ বা পা। কেউ চোখ হারিয়েছে, কেউ বা আবার স্বীয়জীবন উৎসর্গ করেছে তালাবায়ে আরাবিয়ার জন্য। মাদরাসা ছাত্রদের নিকট তেমনি একটি অতি পরিচিত নাম শহীদ আব্দুস সোবহান। যিনি ছাত্রশিবিরের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। এটি শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, একটি স্মৃতি, যা কখনো হৃদয়ের মনিকুটির থেকে মুছে যাবার নয়। তিনি অনন্তকাল ধরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সংগ্রামের প্রেরণা ও দিক-নির্দেশনা হয়ে ধ্রুবতারার মত বিরাজ করবেন।
শহীদ মাওলানা আব্দুস সোবহান ছিলেন এক উদীয়মান নক্ষত্র। মাদরাসা ছাত্রদের আন্দোলনের এক সম্ভাবনাময় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তিনি ১৯৫৬ সালে বৃহত্তর বরিশাল, বর্তমান পিরোজপুর জেলা ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া গ্রামে মরহুম ময়েজউদ্দীন হাওলাদারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়সে তার বাবা মারা যাওয়ায় দরিদ্র ও দুঃখ-কষ্ঠের সাথে সংগ্রাম করে বড় হতে থাকেন।
তিনি গ্রামের মকতবে কুরআন শিক্ষা ও তৎসঙ্গে গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুলে প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম হয়েই পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন। তিনি মাঝামাঝি সময়ে গ্রামের নলকাঠী সিনিয়র মাদরাসা, কুমিল্লার এক মাদরাসা, লক্ষীপুরের বিখ্যাত টুমচর মাদরাসা ও খুলনা আলীয়া মাদরাসা পড়াশুনা করেন এবং ১৯৬৯-এ অসহযোগ আন্দোলনের সময় পড়াশুনা ছেড়ে কিছুদিন খুলনা ইষ্টার্ন জুট মিলে চাকুরী করেন। পরবর্তীতে তিনি সাতক্ষীরা আলীয় মাদরাসা থেকে ১ম বিভাগে দাখিল পাশ করেন। এরপর খুলনা আলীয়া থেকে কৃতিত্বের আলিম ও ফাযিল পাশ করেন।
খুলনা থাকাকালীন শহীদ আব্দুস সোবহান ইসলামী আন্দোলনের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উৎসাহ ও পরামর্শে তিনি ঢাকা আলীয়ায় কামিল হাদীস বিভাগে ভর্তি হন এবং হোস্টেলে অবস্থান করেন। আর্থিক সমস্যার কারণে হোষ্টেল ছেড়ে কামরাঙ্গীরচরে স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব নিয়ে সেখানে চলে যান। সেখান থেকেই তিনি জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ঢাকা শহর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন এবং পড়ালেখা ও পরীক্ষা সংক্রান্ত আলাপ পরামর্শের জন্য মাঝে মধ্যে সহপাঠীদের সঙ্গে হোষ্টেলে অবস্থান করতেন। সেইভাবে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৮ শুক্রবার তিনি ঢাকা আলীয়ার হোস্টেলে অবস্থান করছিলেন।
সকাল সাড়ে আটটা। কেউ রুমে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কেউ বন্ধুদের সাথে আলাপ করছিলেন। কেউ নাস্তা করতে বাইরে রেস্টুরেন্টে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ গোসল ও হাজত সেরে নিচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দু’দল লোক লাঠিসোটা, বড় ছোরা, হকিস্টিক, চেইন ইত্যাদি নিয়ে হোস্টেলে প্রবেশ করে এবং রাত থেকেই ওঁৎপেতে থাকা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের কর্মী বাহিনী মিলে একযোগে তালাবার নেতাকর্মীদের উপর আক্রমন চালায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আইয়ূব ও আব্দুল হাইকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। আব্দুস সোবহানকে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর খুনী আসাদ জুতা দিয়ে তার বুকে আঘাত করতে থাকে। এই পৈশাচিক আক্রমনে সাইয়্যেদ আব্দুল মালেকসহ অনেক নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ শিবিরের ৭জন কর্মীকে গ্রেফতার করে।
আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ১২দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৪ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় মাওলানা আব্দুস সোবহান শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে চির বিদায় নিয়ে পরপারে চলে যান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)।
শহীদ আব্দুস সোবহানের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া পুনরোজ্জীবিত হয়েছে। তার লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া অদ্যাবধি পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
শহীদ আব্দুস সোবহানের ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া সারাদেশে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে সংগঠনটির ঢাকা মহানগরী শাখা ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় মাওলানা আব্দুর রহীম রিসার্চ ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।