|| প্রফেসর ড. মো: মযনুল হক, ইবি. কুষ্টিয়া ||
১৯৪৭ দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়েছিল ভারতবর্ষ। আমাদের পূর্বপুরুষরা হোসেন শহীদ সাহরওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েই আমাদেরকে উপহার দিয়েছিলেন ইষ্ট পাকিস্তান। কিন্তু ইসলামের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার অপপ্রয়াস শুরু থেকেই করেছিল। নব অন্কুরিত একটা রাষ্ট্র ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান’ আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, যার পরিণতিতে ঘটে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, সালাম, বরকত, রফিক জব্বারদের আত্মত্যাগে বাঙালী স্বগৌরবে মাথা উচু করে আদায় করে নেয় রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি।
চাকুরীর বিভিন্ন পদ পদবীতে অনুসৃত হতে থাকে বৈষম্যনীতি, যা বাঙালীর মানসপটে তৈরী করে বিদ্বেষভাব। জাগ্রত জনতা রুখে দাঁড়ায় ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পথ পরিক্রমা পেরিয়ে ৭০এর নির্বাচনে বাঙালীরা পাকিস্তানকে সালামু আলাইকুম জানিয়ে দেয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীত্ব না দিয়ে স্বাধীনতার রাস্তাকে একেবারেই পরিষ্কার করে তুলে এবং বাঙালীদের উপর নেমে আসে ২৫ মার্চের কালো রাত। ২৬ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ইথারে ভেসে আসে স্বাধীনতার ডাক সম্বলিত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কন্ঠস্বর এবং ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। শুরু হয়ে যায় ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক, সামরিক-বেসামরিক জনগণের স্বত:স্ফূর্ত মহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক সহযোগিতায় মুক্তিপাগল বাঙালী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের ও ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে ভারত তার বন্ধুত্বকে প্রভুত্বে পরিণত করার প্রয়াস নেয়, যাকে বীর বাঙালীরা মেনে নিতে পারেনি। আজকের বঙ্গবন্ধু কন্যার এহেন পরিণতির জন্য তাদের অনুসৃত নীতিও যে দায়ী সে কথা কে বলবে?
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে না, মন খুলে কথা বলতে পারে না, ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ, বিচারহীনতা এবং জেল যুলুম হুলিয়া তো হিসেব ছাড়া। এসব বিষয়ে ভারতের একদেশদর্শী ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।
ভারত একটি বৃহদ প্রতিবেশী, যার অবস্থান বাংলাদেশের তিনদিকের সীমান্তকে বেষ্টন করে আছে। বাংলাদেশ নামক এ জনপদের মানুষ প্রত্যাশা করে ভারত অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবেই থাকুক। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে অন্য আরেকটি রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক সেই ধরনের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কই কাম্য। আমরা সবাই জানি বন্ধু পাল্টানো যায় কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। স্বাধীনতার সময়কালের সহযোগিতা আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি কিন্তু প্রভুত্ব কামনা করি না।
বাংলাদেশের স্বাধনিতার ইতিহাসে রাজাকার শব্দটি অত্যন্ত ঘৃণিত একটি শব্দ। যারা বেঈমানী করেছিল এ দেশের মানুষের সাথে, যারা সহযোগিতা করেছিল পাকিস্তানী সেনাদের এদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন কেড়ে নিতে, হত্যা, লুটতরাজ ও নারীদের সম্ভ্রমহানী করতে। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর এই শব্দটিকে নিয়ে নব প্রজন্মের কন্ঠে শ্লোগান তুলে দিলেন যারা, তাদেরকে আমি কী অভিধায় বিশেষায়িত করবো বুঝে আসছে না, কারণ তারাই স্বাধীনতা আনয়নের দাবীদার। এতে একাত্তরের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের হানি ঘটানো হয়েছে যদিও নব প্রজন্মের শ্লোগান ছিল-
“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার
কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার
চাইতে গেলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার রাজাকার”
বাস্তবতাতো এটাই যে, আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে রাজাকারের বাচ্চা বলাটাই ছিল একটা নিরেট বোকামী, কারণ এ প্রজন্মের অনেকের বাবার জন্মই স্বাধীনতার পরে। এটা যদি স্লীপ অব ট্যাঙ্গও হয়ে থাকে তথাপি এটা রাজ্যের ক্ষতি করেছে, যা শুধু সরকারকে সিংহাসনচ্যুতই করেনি মহান মুক্তিযুদ্ধের গায়ে কালিমা লেপন করেছে। এ শব্দ নিয়ে অবশ্যই আমার ঘোর আপত্তি রয়েছে কারণ আমার পরিবারে দুই সদস্য মুক্তিযোদ্ধা থাকায় আমাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিতে পাকিস্তান আর্মিকে সহযোগিতা করেছিল রাজাকাররা।
সরকার পতনের কারণ বিশ্লেষণ হয়তো আরো পড়ে হবে ব্যাপক ভিত্তিক সেটাকে পাশকাটিয়ে অভিনন্দন জানাতে চাই নব প্রজন্মের সিপাহসালারদের যাদের দৃঢ়তা, জীবন বাজী রেখে বুক পেতে দেয়া আবু সাঈদ, রাফি. পানির ফেরিওয়ালা মুগ্ধ, নাম না জানা শত শত শহীদের জীবনদানের যে নজীর রেখে গেলো, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণ করবে। আমরা একাত্তরের আত্মদানকারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভ্রম হারানো মা বোনের প্রতি যে রকম ভক্তি ও শ্রদ্ধা রাখি, এ প্রজন্মের শহীদদের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধাভক্তি অটুট থাকুক, তাদের সবার ত্যাগকে আল্লাহ কবুল করুন এবং জান্নাতের ফয়সালা করুন। বিজয়ী বীরদেরকেও লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।
বিজয় অর্জনের চেয়ে বিজয়কে সাফল্যমণ্ডিত করা ঢের বেশী কষ্ট সাধ্য। বিজয়ী ছাত্র-জনতার দায়বদ্ধতার জায়গাটি অনেক প্রসারিত হয়েছে। কাজেই আমাদের সচেতনতার প্রখরতার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সংখ্যালুঘু সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদেরকে সচেতন হতে হবে, যাতে কোন গোষ্ঠী তাদের জান মালের ক্ষতি সাধন করতে না পারে। এ ধরনের সাবোটাজ থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে দেখভালের দায়িত্ব বিজয়ী দাবিদারদেরকেই নিতে হবে। সেই সাথে প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির কবর দিতে হবে বাংলাদেশে। আগামীদিনগুলোতে যাতে রাজনীতির ভিন্নতায় কেউ আঘাত প্রাপ্ত না হয়, সেটার নিশ্চয়তা বিধান বিজয়ীদেরকেই করতে হবে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন স্বাভাবিক গতিতে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে। যে কারণে জনতার সম্পৃক্ততা বেড়েছে ছাত্রদের আন্দোলনে এবং ছাত্র-জনতা সফলকাম হয়েছে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে। তবে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেজন্য প্রথমেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে ব্যক্তি চয়েজের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী এবং প্রয়োজনে এক সপ্তাহ সময় দেয়া উচিৎ।
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে যা করা প্রয়োজন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি:
- জাতির মানসিক শক্তির বিকাশে জাতিকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিতকরণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মূল্যবোধের যথার্থ মূল্যায়ন, যা বহি:শত্রুর মোকাবেলায় সন্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করবে পরবর্তী প্রজন্মকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে।
- শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সকল নাগরিকের শিক্ষাদানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার সমসুযোগ তৈরীর দরজা উন্মুক্তকরণ এবং নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষানীতি গ্রহণ যাতে কোন রাস্কেল তৈরী না হয়, সম্পদ লুটকারী না হয়, দেশদ্রোহী না হয়। দেশ ও জাতির কাছেই সে দায়বদ্ধ শুধু নয়, স্রষ্টার কাছেও সে দায়বদ্ধ হিসেবে গড়ে উঠবে। শিক্ষাকে নৈতিক মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা না গেলে কাংখিত নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরী সম্ভব নয়। শিক্ষাদানের মূল কারিগর যারা তাঁদের সুযোগ সুবিধার প্রতিও দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো প্রয়োজন এবং শিক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বাজেটে স্থান দেয়াটা জরুরী।
- স্বাধীনতা অর্থ অন্যের ক্ষতি না করে যে অধিকার ভোগ করা যায় এবং প্রয়োগ করা যায়। আমার অধিকারের যে সীমা সেটা যদি অতিক্রম করে অন্যের সীমানায় ঢুকে যাই তবে তা যুলুম, এই যুলুমের অবসানে রাষ্ট্রকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং তা প্রদানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যথোপযুক্ত চাকুরীর ব্যবস্থা করা, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তায় পরিণত করার প্রনোদনা প্রদানও রাষ্ট্রে দায়িত্ব।
- সংবিধানে বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক ধারার প্রয়োজনীয় সংশোধনী, বিয়োজন ও সংযোজনের লক্ষ্যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন সময়ের দাবী।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, সর্বস্তরে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে প্রামাণ্যতা দেয়া জরুরী।
- দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট (উচ্চ কক্ষ ও নিম্নকক্ষ) জাতীয় সংসদ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর প্রয়াস নিতে সকল দলকে উদ্বুদ্ধকরণ।
- রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
- ইলেক্ট্রনিকস ও প্রীন্ট মিডিয়ার জন্য স্বাধীন ও অবাধ নীতিমালা তৈরীতে কমিশন গঠন।
- যুব সমাজের উন্নয়নে বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বেকারত্ব দূরীকরণে জব সেক্টর তৈরীতে ভিশনারী পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী।
- স্বাস্থ্য সেবাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জাতি গোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্যকরণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা পৌছানোর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার।
- বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরমত সহিষ্ণতার মূল্যবোধকে আত্মস্তকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় – আপ্ত বাক্যটিকে আমরা যতটা মুখে আউরাই ক্ষমতায় গেলে সব ভুলে যাই। অন্তত আমরা আশা করি, পরবর্তী সরকার এ ধারার পরিবর্তনে দৃষ্টান্ত তৈরীতে বদ্ধপরিকর হবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক : গবেষক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং অন্যতম জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।