|| ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ||
নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও মুক্তির অন্বেষা
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পেছনে আগাগোড়া কৃতিত্ব ছাত্রনেতৃত্বের। কারণ, আন্দোলনের শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত চেনাজানা রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামেনি। কেউ কেউ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন।
জাতির বিবেক বলে দাবিদার কতিপয় সাংবাদিক নেতাকেও দেখা গেছে হালওয়া রুটির নেশায় বিবেক বন্ধক দিয়েছিলেন। সরকারের দমননীতির পক্ষে ওকালতি করেছেন। তবে শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের অনেক সাহসী কলাকুশলি, বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবি, যাদের এতদিন আওয়ামী ঘরানার মনে করা হত, তাদের অনেকে মাঠে নেমেছিলেন। চরমোনাইর পীর ছাহেবের লোকজন ছাড়া ইসলামী ঘরণার কোনো দল বা মহল মাঠে নেমেছিলেন কিনা জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। শেষ দিকে প্রাক্তন সামরিক অফিসাররা ছাত্রদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ নির্বিচার গুলির প্রতিবাদে মিছিল করলে এ বিজয় ত্বরান্বিত হয়।
দৃশমান এই নেতৃত্ব শূন্যতা সত্ত্বেও ছাত্রনেতা সমন্বয়কদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ, বক্তৃতা বিবৃতি ও ঘোষণায় শব্দচয়ন ছিল সুচিন্তিত, যথাযথ ও বিচক্ষণতাপূর্ণ। বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের এই বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, নির্লোভ নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য রাজনীতি বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে একদিন।
এক সুহৃদ বললেন, এই অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নিয়ে এতবেশি উৎসাহী হওয়ার কি আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস, তিনি তো আমেরিকার লোক। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, দুনিয়াজোড়া সম্মান কুড়িয়েছেন তা ঠিক; কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কী করেছেন, তার কী অবদান আছে।
বললাম, বিশ্বের কোনো স্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসলে আমেরিকা হাত প্রসারিত করবে না বা স্বার্থ শিকার করবে না, এমন কথা কেউ বললেও আমি বিশ্বাস করব না। তবে বাংলাদেশের বেলায় আমাদের তরুণ প্রজন্মের সচেতনা, বিচক্ষণতা যা পর্যন্ত আমরা দেখেছি, এটিই দেশ ও জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে পাহারা দেবে, এই বিশ্বাস রাখতে চাই।
বললাম, শেখ হাসিনার আমলে কী পরিমান জুলুম ও অত্যাচার হয়েছে তার একটি নমুনা আয়নাঘর। শেখ হাসিনার আয়নাঘরকে বলতে হবে জাহান্নামের জ্বলামুখ । এর আগে পরিভাষাটি আমরা কখনো শুনিনি এবং ভয়ানক নির্যাতনকেন্দ্র অর্থে আয়নাঘর এখনো ডিকশনারীতে স্থান পায়নি।
জননিরাপত্তার বিষয় ছাড়াও উপর তলার চুরিচামারি, জালিয়তি, অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশকে ফতুর বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রের রিজার্ভ চুরির মতো বিরল ঘটনা শেখ হাসিনার আমলেই সম্ভব হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে দেশের ভেতর বাহির থেকে। এক বেরসিক বন্ধু বললেন, তার আমলে দেশ বেশ উন্নত হয়েছে। আগে সবজির বাজারে গড়পড়তা দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। এখন তা ৮০ থেকে ১২০ টাকা। তিনি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিক, কিন্তু তলে তলে মাদ্রাসাগুলোকে স্কুল কলেজ বানানোর প্রক্রিয়া পাকাপোক্ত করেছেন। স্কুলের দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার ১০০ নম্বরের ধর্মীয় বিষয় তুলে দিয়ে নাস্তিক প্রজন্ম তৈরির কর্মেকৌশল প্রয়োগ করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেবদেবি, মন্দির সংস্কৃতি আর যৌনাচার, বেহায়াপনা চর্চার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ এটিই। এবং তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থান জাতির বুকের উপর থেকে জগদ্দল পাথর অপসারিত করেছে। এই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ এখানেই। বললাম, আপনি ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে একজন ইসলামী নেতা ভাবতে চেষ্টা করছেন, এ জন্যেই আপনার হিসাব মিলছে না। (চলবে…..)
লেখক: ইসলামিক স্কলার ও গবেষক এবং ফিচার সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।