|| খাজা ওসমান ফারুকী (খাজা’জী) ||
কু’রআনে একটি ব্যাপার বার বার ঘুরে ফিরে আসে: আল্লাহর প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন : “যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। [সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭] ‘আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল স্বীয় কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর সে অকৃতজ্ঞ হলে তো আল্লাহ অভাবমুক্ত প্রশংসিত’। (সূরা লুক্বমান ৩১:১২) -‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর ও অকৃতজ্ঞ হয়ো না’। ( ২:১৫২)
প্রশ্ন আসে: আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য এত জোর দেওয়া হয়েছে কেন? আল্লাহর তো কোনো কিছুর দরকার নেই? তাহলে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে? কৃতজ্ঞতা হচ্ছে সর্বোত্তম মনোভাব। কেননা, এটি আমাদেরকে সুখী করে এবং অপরের প্রতি আরও সদয় হতে সাহায্য করে। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ কি সত্যিই শক্তিশালী?
টাইম ম্যাগাজিনে একটি আর্টিকেল বের হয়েছে কৃতজ্ঞতার উপকারিতার উপরে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে ২,৬১৬ জন বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে: যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়-ভীতি, অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি অনেক কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে: মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে, নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল, উপেক্ষিত মনে করা, ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়। ২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয়, যাদের মধ্যে ৪০%-এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা একনাগাড়ে বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।
নিউইয়র্কের Hofstra University সাইকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. জেফ্রি ফ্রহ ১০৩৫ জন ১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন: যারা বেশি কৃতজ্ঞতা দেখায়, তাদের পরীক্ষায় ফলাফল অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো, সামাজিকভাবে বেশি মেলামেশা করে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই মানসিক সমস্যাগুলো মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আশংকাজনকভাবে কম।
কৃতজ্ঞতার স্নায়ুবিজ্ঞান ও মস্তিষ্কে এর প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা রয়েছে। গবেষকরা দেখেছে, মস্তিষ্কের ভেন্ট্রোমেডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স কৃতজ্ঞতা নিয়ন্ত্রণ করে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। মস্তিষ্কে আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী ২টি গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন ও সেরোটোনিন বাড়ায় কৃতজ্ঞতা। এটি আমাদের মেজাজ ভালো রাখে, ভেতরে থেকে আনন্দ ও সুস্থতার ইতিবাচক অনুভূতি দেয়। কৃতজ্ঞতা মানুষকে আরও সুখী ও আশাবাদী বোধ করতে, সুন্দরভাবে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে এবং শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
Wall Street Journal এর একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে—
যেসব বয়স্ক মানুষ প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন: তাদের কর্মস্পৃহা, জীবনসম্বন্ধে তাদের আস্থা, তাদের সামাজিক মেলামেশা, এবং তাদের সুখানুভূতি কৃতজ্ঞতাবোধহীনদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে –প্রায় এক যুগ গবেষণার ফল থেকে এটি জানা গেছে। এদের মধ্যে হতাশা, ঈর্ষা, লোভ অথবা মদ্যপানে আসক্তি আসার সম্ভাবনা কম। এরা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করে থাকে, এরা গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, এরা নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ পায় এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও এদের বেশি। এবার বুঝতে পারছেন, কেন আমাদের প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে, কমপক্ষে ১৭ বার সুরা ফাতিহায় বলা উচিত—আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন
সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রভু। [ফাতিহা ১:২]
আপনার এই রকম বোধ থাকা উচিৎ যে, “আজ আমার যথেষ্ট খাবার আছে, আমি কৃতজ্ঞ। জীবন যাপনের জন্য আরো একটি দিন আমি পেয়েছি, আমি কৃতজ্ঞ। এই সকালে আবার আমি সজীব প্রাণে জেগে উঠেছি; আজ আবার আমাকে সূর্য আলো দিতে এসেছে; আজ আবার আমি চন্দ্রোদয় দেখব; আজ আমি বেঁচে আছি! আজ আমি নাও বেঁচে থাকতে পারতাম, আমি আজ কবরে থাকতে পারতাম- কিন্তু আবার আমি জীবন পেয়েছি। আমি একে অর্জন করিনি। কোন কিছুর বিনিময়ে আমাকে দেয়া হয়নি। অন্তত এই কারণে আপনার আন্তরিকভাবে বাধিত, কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে। আপনি খাবার গ্রহণ করছেন, পান করছেন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন-এই সব কিছুর জন্য আপনার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা থাকা উচিৎ। সম্পূর্ণ জীবন, এই অপার মহাবিশ্ব, সমস্ত প্রকৃতি এবং মহান আল্লাহর প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতার বোধ থাকা উচিত ‘বেঁচে থাকার জন্য আমি আরও একটা দিন পেয়েছি। তোমার অনুগ্রহে আমি অভিভূত। এবং তোমার দেয়া এই জীবনে যত দুঃখ কষ্ট পেয়েছি তা আমারই ভুলের কারণে, তোমার দেয়া এই জীবন খুবই আনন্দময়। অবশ্যই আমার ভুলে কষ্ট পেয়েছি। তোমার দেয়া এই জীবন পরমানন্দের এবং আমি তার জন্য মনে প্রাণে কৃতজ্ঞ। শোকর আলহামদুলিল্লাহ। এই বোধ, এই কৃতজ্ঞতার বোধ জীবনের সব ক্ষেত্রে থাকা উচিত।
আপনি আসলে কৃতজ্ঞতা ছাড়া শক্তিহীন। আপনি যখন কৃতজ্ঞতা নামক শক্তি ছড়িয়ে দেন চারপাশে, সেটার বিনিময়েও কৃতজ্ঞতা পাবেন। যা আপনাকে উৎস শক্তির কাছে নিয়ে যাবে, আপনার ফ্রিকোয়েন্সিকে উন্নত করে তুলবে প্রতিবার কৃতজ্ঞতা বিনিময়ের সাথে সাথে। এতে আপনি শুধু উৎস শক্তির প্রতিই কৃতজ্ঞ থাকবেন তা নয়, বরং নিজের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। আর এটাই হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসার আরেক নাম। কৃতজ্ঞতাবোধের শক্তির রূপই এমন। অপেক্ষা করুন, এতটুকুই সব না। আরও আছে। কৃতজ্ঞতাবোধ আপনার বিশ্বাসকেও মজবুত করে তোলে।
বিশ্বাস হচ্ছে অজানার উপর আস্থা রাখার দুঃসাহসিকতা। বিশ্বাস হচ্ছে সেই শক্তি যার উপর ভরসা করে পরিচিত জীবন ছেড়ে অজানা জীবনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। বিশ্বাস অজানার ভয় দূর করে দেয়, ঝুঁকি নিতে সাহস যোগায়। আপনি যখন ভীত, তখন বিশ্বাসই আপনার সবথেকে বড় বন্ধু।
আল্লাহর অনুসন্ধানের জন্য ইবাদাত-বন্দেগী, এবং মুরাকাবা, মেডিটেশন বা ধ্যানের চেয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর উপায় আর কিছুই নেই। সারাক্ষণ কর্মব্যস্ততায় কাটালে আপনার জীবন ক্রমশঃ যান্ত্রিক জীবনে পরিণত হবে এবং কাজের চাপে আপনি আল্লাহকে ভুলে থাকবেন। যদি কেবল জ্ঞানের বা বিচার-বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে আপনি তাঁর সন্ধান করেন, তাহলে যুক্তিজালে জড়িয়ে পড়ে আপনি তাঁকেই হারিয়ে বসবেন।
যদি আপনার সন্ধান কেবল ভক্তিনির্ভর হয়, তাহলে আপনার উন্নতি শুধু আবেগের বশীভূত হতে পারে। সুফি সাধকদের সিলসিলায় ধ্যানের মধ্যে এই সমস্ত পথের একটা সুষম সংযোগ ও মিলন দেখা যায়। কাঠকয়লা এবং হীরে- দুটোর ওপরেই সূর্যের আলো সমানভাবে পড়লেও শুধু হীরেই পারে আলোকে বিচ্ছুরিত করতে। তেমনি শুদ্ধ মনের মানুষই পারে আত্মাকে জানতে ও তাঁর গুণকে প্রতিফলিত করতে।
সুফি মেডিটেশন মানে হচ্ছে জাগ্রত হওয়া, অস্তিত্বের প্রত্যেকটি (ফাইবার প্রেসার) কম্পিত, সতর্ক সচেতন এবং সচেতনতার সেই মাত্রা প্রথম বারের মত আপনাকে জানায় কোন মনে কোন অহং নেই যখনই আপনি আল্লাহু জিকিরের গভীরে ডুব দিয়েছেন। অহম মিলিয়ে গেছে আপনার ভেতর থেকে। তখন আপনি একক সমগ্রের সাথে এবং সমগ্র বিস্তৃত- একক হয়ে উঠা অস্তিত্বের সাথে, এটাই সুফি মেডিটেশন।
সত্যিকারের সুখ মানসিক প্রশান্তি থেকেই আসে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অপরকে সহযোগিতা করা, ক্ষমা করা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের অবদান মনে রাখা। ধ্যান করার অনেক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপকারিতা রয়েছে। যেমন: চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমানো সম্ভব ধ্যানের মাধ্যমে। কিন্তু সর্বপ্রথমেই আমাদেরকে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে, নিজের গন্তব্য খুঁজে পেতে মনস্থির করতে হবে এবং নিজেকেই আরও সহযোগিতা করতে হবে। সুফি মেডিটেশন এই বিচূর্ণ অংশ এবং অন্তঃসারশূন্যতা থেকে নিরাময়ের গাইডলাইন হবে।
আত্মিক ও মানসিক সুস্থতার পথ দেখাবে…
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, সুফি সেন্টার, চট্টগ্রাম।